“ফিজ দিলেই শহরে মিলবে যুবতী ডাক্তারের সেবা” [কাদাম্বিনি গাঙ্গুলি সম্পর্কে জানুন অজানা কথা]


“ফিজ দিলেই শহরে মিলবে যুবতী ডাক্তারের সেবা..।” 

বাংলার একসময়ের নামকরা পত্রিকা ‘বঙ্গবাসী’ তে এহেন নোংরা, নির্লজ্জ ইঙ্গিতটি যার সম্পর্কে করা হয়েছিলো তিনি আর কেউ নন ভারত তথা এশিয়ার প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলী। প্রথম মহিলা ডাক্তার হওয়ার সুবাদে তাঁকে কম অপমান সহ্য করতে হয়নি.. এই কারণেই রক্ষণশীল সমাজ রীতিমতো ঘৃণার চোখে দেখতো তাকে।

এমনই এক পরিবার ছিল কলকাতার রায়চৌধুরী পরিবার। গৃহকর্তা মনে করতেন মেয়েদের স্থান অন্দরমহলে। আধুনিক শিক্ষা বিগড়ে দেয় মেয়েদের। সেই পরিবারের আদরের কন্যা সন্তানসম্ভবা। মেয়েকে নিজের কাছে আনিয়ে রাখলেন। একদিন রাত্রে প্রসব বেদনা উঠলো। ধাই মা বলা ছিলো। কিন্তু পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠলো। মেয়ে তখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। পরিবারের চিকিৎসকের ডাক পড়লো। তিনি পর্দার বাইরে বসে শুনে শুনে নিদান দিতে শুরু করলেন। ধাই সুবিধা করতে পারলেন না। আসতে আসতে এলিয়ে পড়তে লাগলেন সুলতা। ডাক্তার সেন কর্তাকে ডেকে বললেন, এইভাবে চিকিৎসা সম্ভব না। যদি পুরুষ ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা না করান, কাদম্বিনী গাঙ্গুলিকে কল দিন। সম্প্রতি লন্ডন থেকে বিরাট ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছেন। একটু ইতস্তত করে কর্তা বললেন, এই রাত্রে তিনি আসবেন? সমাজ কী বলবে তাকে? ঝংকার দিয়ে উঠলেন ডাক্তার সেন। সমাজ বলতে তো আপনাদের মতো গোঁড়া লোকেরা। আধুনিক পৃথিবীতে তাদের মতামতের কোনো দাম নেই শিক্ষিতদের কাছে। আপনারা এবার মুখ বন্ধ রাখুন। মেয়েটাকে বাঁচান আগে।

লজ্জা, সংস্কার, ঐতিহ্যের অহংকার চেপে রেখে রায়চৌধুরী বাড়ির গাড়ি গিয়ে দাঁড়ালো কাদম্বিনীর দ্বারে।কাদম্বিনী জানতেন এই রক্ষণশীল পরিবারটিকে। গাঙ্গুলিদের সমাজচ্যুত করার জন্য তারা খু্বই সচেষ্ট ছিলেন।সেই পরিবার আজ তার শরণাগত। মুহূর্তে তৈরি হলেন তিনি। গাড়িতেই শুনে নিলেন কেস হিস্ট্রি। তৈরি হলেন মনে মনে, আজ তার আসল পরীক্ষা। রায়চৌধুরী বাড়িতে সেদিন যমে মানুষে টানাটানি। খুব ক্রিটিকাল কন্ডিশন। পেশেন্ট খুব খারাপ অবস্থায়। তিনি বললেন, আপনাদের গাফিলতিতে আজ এই পরিস্থিতি। পেশেন্টকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু বেবির কোনো গ্যারান্টি নেই। অবশেষে বেরিয়ে এলেন ক্লান্ত কাদম্বিনী দেবী। 

ঘরের ভেতরে কান্নার আওয়াজ। না সে আওয়াজ দুঃখের নয়, কচি গলার কান্না, স্বস্তির কান্না। রায়চৌধুরী বাবু এগিয়ে এলেন। কাদম্বিনী গম্ভীর মুখে বললেন আপনার মেয়ে সুস্থ আছে। বেবিও পুরো ফিট। নাতনি হয়েছে আপনার। প্রৌঢ়ের চোখে চকচক করে উঠলো জল। আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাই? আশীর্বাদ করুন এই মেয়ে যেন আপনার মতোই 'ডাক্তার' হয়। আপনার ফিজ কতো দেবো মা? 

হঠাৎ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেলো কাদম্বিনীর গলা। ফিজ দিতে হবে না। যেটা বললেন সেটাই করুন। মেয়েটাকে শিক্ষা দিন। বিকশিত হতে দিন কুঁড়িগুলিকে। হুস করে বেরিয়ে গেলো কাদম্বিনীর গাড়ি।

এই হলেন কাদম্বিনী। সমাজের কলঙ্ক গায়ে মেখেও সংকল্পে ছিলেন অটুট। রক্ষণশীল পরিবারের মহিলাদের অসুস্থতায় ডাক পেলেই যেতেন রাতবিরেতে। চিকিৎসার বিনিময়ে সংকল্প করিয়ে নিতেন মেয়েদের শিক্ষা দেবার। তাঁর থেকে সাহস পেয়ে, তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বহু নারী এগিয়ে এসেছেন নিষেধের বাধা ঠেলে। এগিয়েছে সমাজ, এগিয়েছে দেশ। আজ ভারতের যত মহিলা চিকিৎসক, সবার কাছে তিনি ভগীরথ, পথপ্রদর্শক।
কাদম্বিনী গাঙ্গুলি, শুধু চিকিৎসক নন, এক লড়াই, এক সংস্কারক, এক প্রেরণা। কিন্তু বাংলাদেশে এখন কেউ তাঁকে চেনে না। যারা চিনতেন তাঁরা গত হয়েছেন।

তিনি আজ বিস্মৃতির অন্ধকারে। তাঁর নামে হয়নি মেডিকেল কলেজ, রাস্তা, মূর্তি কোনো কিছুই। তিনি তা চান ও নি। যা চেয়েছেন তা হয়েছে, হাজারে হাজারে মেয়ে নিচ্ছে চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ। স্বপ্ন দেখছে চিকিৎসক হবার। সেই স্বপ্নই দেখিয়েছিলেন তিনি।

২১শে জুলাই তাঁর জন্মদিন। জন্মদিবসে আমাদের পক্ষ থেকে রইলো বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আরো পড়ুন -->>

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. রচনাটি যথাযোগ্য বোধ করিতেছি। এই প্রাকারের নিবন্ধ অারো অধিক পাঠ প্রত্যাশা জানাই এবং জানালাম।

    উত্তরমুছুন

অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্যের দায় মন্তব্যকারীর, সম্পাদকের নয়।