শিল্প ও সত্য - ২ / মো. আরাফাত হোসেন রাফি

 


শিল্পীর স্বপ্ন বলতে প্রকৃত অর্থে কী বোঝায় এবং তা আমাদের কী জানান দেয়?


একজন সুন্দরী নারীর চিত্র কাকে মডেল ধরে আঁকা হয়েছে তা জরুরি নয়, বরং তা সুন্দরের আদর্শ প্রকাশ কি না সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। পালমা ভেকিয়োর ABlonde Woman  বিশেষ কোনো নারীর প্রতিকৃতি নয়, বরং আদর্শ সুন্দরী নারীর প্রতিরূপ কিংবা বলা যেতে পারে যে ভেকিয়োর কল্পনায় ধরা পড়া নারীর আদর্শ রূপ বা আদল। রেনেসাঁ চিত্রীরা সচেতনভাবে মানুষের আদর্শ রূপ তুলে ধরেছেন। আদর্শায়ন আমাদের প্লেটোর গড়ন সম্পর্কিত তত্ত্ব মনে করিয়ে দেয়। ‘আদর্শায়নে শিল্প বিশেষ কোনো বস্তুকে নয়, গড়নকে অনুকরণ করে’, তিনি বলেছিলেন। কিন্তু বিতর্ক করে বলা যায় যেকোনো কিছুই অনুকরণ করে নির্মিত হয় না, কারণ আদর্শ বা স্বপ্ন শিল্পকর্মটি সমাপ্ত হওয়ার আগে মূর্ত হয়ে ওঠে না। প্লেটো মনে করতেন যে গড়নই হলো চূড়ান্ত বাস্তবতা এবং গড়নের জ্ঞানই গভীর সত্যের জ্ঞান। অনুকরণের মাধ্যমে তাকে প্রকাশ করলে সত্যই প্রকাশ করা হয়। যদি আমরা প্লেটোর গড়ন সম্পর্কিত তত্ত্ব গ্রহণ নাও করি, আদর্শায়ন কোনো সত্য হয়তো প্রকাশ করে থাকে। আদর্শায়ন মানুষের শৈল্পিক বিচারের একটি প্রকাশ, যা উপলব্ধির ভেতর দিয়ে নিজস্ব বিচার-বিশ্লেষণের সঙ্গে তুলনা সম্ভব হয়ে ওঠে। একটি আদর্শে অভিজ্ঞতার প্রতিফলন থাকে এবং তাকে একটি মানদণ্ড মনে করে নিজস্ব অভিজ্ঞতার স্বরূপটি জানা যায়। শিল্প সাধারণের যে মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকে তাও এক ধরনের সত্যের প্রকাশ বলে মনে করা হয়। একটি ব্যক্তি বা বস্তু কত বেশি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত তা-ই দর্শকের মনোযোগ কেড়ে থাকে। Van Gogh’s Chair সেই রকম একটি চিত্রকর্ম। দৈনন্দিন জীবনে যা আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, শিল্পী সেই সত্য দেখে থাকেন এবং তার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অস্তিত্বের মূল্যায়ন করেন। সেই কারণেই আমরা শিল্পকে এতটা মূল্যবান মনে করি। কিন্তু সব শিল্পই স্বপ্ন বা সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করে না। অনেক শিল্পকর্ম আছে, যা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, শুধু উপভোগের জন্য সৃষ্টি। আবার শিল্প থেকে অনেক তথ্য প্রাপ্তির প্রত্যাশা শিল্প উপভোগের ধরনটিকে বুদ্ধিবৃত্তিক করে তোলে। আমরা সবসময় সাদৃশ্য, পরোক্ষ মিল, বারতা, স্বপ্ন ইত্যাদি খুঁজে ফিরি, কিন্তু শিল্পীর স্বপ্ন শুধু সত্য প্রকাশের জন্য মূল্যবান নয়, তার প্রকাশধর্মী, আবেগধর্মী ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের জন্যও বটে। আবার চিত্রকর্ম থেকে সবসময় বারতা পাওয়া যায় না। আর তথ্য বা বারতার ওপর সবসময় জোর দেওয়া হলে শিল্প হিসেবে একটি চিত্রকর্ম যা দিতে পারত তা পাওয়া সম্ভব হয় না।


কখনো কখনো শিল্পকর্ম সত্য না মিথ্যা তা নির্ণয়ে ঐতিহ্যের ওপর নির্ভর করা হয়। কিন্তু এ বিষয়েও ভিন্নমত রয়েছে। শিল্পকর্ম ঐতিহ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। খুব কমসংখ্যক শিল্পকর্মেরই ঐতিহ্যের সূত্র রয়েছে। অনেক সমালোচকই বিশ্বাস করেন যে শিল্প সবসময় সত্য তুলে ধরে, যা ওই শিল্পকর্মের মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু সবচেয়ে বাস্তববাদী বা স্বভাববাদী ধারার চিত্রকলাও অনেক ক্ষেত্রে ঐতিহ্যসূত্র তুলে ধরে না বা কিছু বোঝায়ও না। যেমন, সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে ভেসে আসা একটি কাঠ পাওয়া গেল যার আকৃতি পাখির মতো। এটা দেখে বিস্মিত হওয়া যায় বটে, কিন্তু তা পাখিকে উপস্থাপন করে না। এটা পাখির মতো হলেও পাখি নয়। এটা একটি কাঠ। এই সাদৃশ্য সত্যের অন্তর্গত নয়। সাদৃশ্য ও উপস্থাপনার মধ্যে পার্থক্য আছে। শিল্পকর্ম, শিল্পবস্তু ও প্রথার মধ্যে একটি আন্তসম্পর্ক আছে। শিল্পবস্তুকে শিল্পকর্মে তুলে ধরার জন্য সাদৃশ্য ও প্রথার প্রয়োজন রয়েছে। এই দুইয়ের মাঝে যে সম্পর্ক তা একে অপরের পরিপূরকই শুধু নয়, তা একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্কের ফাঁকটুকুও পূরণ করে থাকে। যেখানে এই দুইয়ের সম্পর্ক গভীর সেখানে ঐতিহ্যসূত্র ততই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, কারণ এই চিত্রকর্মগুলো রং, রেখা, বায়ব্য ও রৈখিক পরিপ্রেক্ষিতসহ বাস্তবতা তুলে ধরে এবং দর্শকরা তাকে বস্তু ও ঐক্ষিক জগতের উপস্থাপনা ব্যতিরেকে আর কিছু ভাবতে পারে না। কিন্তু আসলে তা জগতকে সঠিকরূপে তুলে ধরে না। চিত্রকলার ক্ষেত্রে যেখানে সাদৃশ্য খুব কম সেখানেও তা জগতের কোনো কিছুর রূপ বা আদল তুলে ধরে। বিভিন্ন শিল্পীর হাতে একই জিনিসের রূপ বা আদলের নির্মাণ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু চূড়ান্তভাবে তা মূলবস্তুকেই মনে করিয়ে দেয়। অর্থ্যাৎ শৈলীর ভিন্নতা থাকলেও শেষমেশ তা বাস্তবতাই তুলে ধরে। দৃশ্য চিত্রণে পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণ আমাদের কাছে ‘সঠিক’ মনে হয় আর এই ধারণাটি আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছি। এই শৈলীগত সূক্ষ্মতা রেনেসাঁ যুগের অর্জন। কিন্তু তার পরও বেশির ভাগ ছবিতে এই বৈশিষ্ট্যের বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যায়। চিত্রপটে স্থান ছাড়ার বিষয়টিও একটি শৈল্পিক দক্ষতা যার সঙ্গে চিত্রের ‘সঠিক’ হওয়া না হওয়ার ধারণাটি যুক্ত। কিন্তু ছবিতে সঠিক রূপ বা আদলে জগতের বস্তুপুঞ্জ তুলে ধরাই শেষ কথা নয়। তার সঙ্গে কোনো ঘটনা, কাহিনী বা বিষয় জড়িত থাকতে পারে যা ওই ছবির অন্তর্নিহিত সত্য।


লেখক : শিক্ষার্থী, নিটার, প্রযুক্তি ইউনিট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


আরো পড়ুন -->>

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ