কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম-এর একটি দুর্লভ সাক্ষাৎকার।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তুখোড় রাজনীতিক, মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকসু ভিপি। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) বর্তমান সভাপতিও তিনি। তাঁর সংগ্রামমুখর জীবনের গল্প শুনেছেন রুদ্র আরিফ। ছবি তুলেছেন কাকলী প্রধান
দৈনিক কালের কন্ঠ, ২৯ মার্চ, ২০১৯

ছোটবেলায়ই নিজের নাম থেকে ‘খান’ শব্দটি বাদ দিয়েছিলেন...

আমি জন্মেছি ১৯৪৮ সালের ১৬ এপ্রিল ভোরবেলা, সাভারের গেন্ডা গ্রামে। আমার নাম ছিল মুজাহিদুল ইসলাম খান। ডাকনাম সেলিম। ষাটের দশকে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক ছিলেন আইয়ুব খান। তখন থেকেই নিজের নাম থেকে ‘খান’ শব্দটি বাদ দিয়ে সেখানে ডাকনাম সংযুক্ত করেছি। আমার বাবা মোসলেহ উদ্দিন খান ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। মা উম্মেহানি খানম ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রী। তাঁদের আট সন্তানের মধ্যে আমিই একমাত্র পুত্র ও তৃতীয় সন্তান। আমার যখন এক বছর বয়স, তখন বাবার চাকরিসূত্রে আমরা ঢাকায় চলে আসি। আমার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে। এরপর নয়াপল্টনে আমাদের নতুন বাসার কাছাকাছি ঢাকা কলেজিয়েট ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হই। বর্তমানে বিলুপ্ত সেই স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর ১৯৫৭ সালে ভর্তি হই সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে। প্রায় প্রতিটি ক্লাসেই আমি প্রথম হতাম। ১৯৬৫ সালে ইংরেজি মাধ্যমে এসএসসি পাস করি। ফল প্রকাশের পর দেখলাম, সম্মিলিত মেধাতালিকায় অষ্টম হয়েছি।

সে সময়ে ‘আসিয়া’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন...

আমার জীবনের একটা পর্ব একটু ভিন্ন ধরনের ছিল। রেডিওতে তখন কবি ফররুখ আহমদের পরিচালনায় শিশুদের জন্য একটি অনুষ্ঠান হতো ‘খেলাঘর’। সেখানে এক দিন আমাকে বলা হলো, “তোমাকে কবি ইকবালের লেখা ‘বাচ্চো কি দোয়া’র বাংলা অনুবাদ আবৃত্তি করতে হবে।” করলাম। আমাকে পাঁচ টাকা সম্মানী দেওয়া হলো। সেই টাকা দিয়ে নানাকে একটা টুপি আর একটা ‘রাইটার’ কলম কিনে দিয়েছিলাম। ওই যে রেডিওতে আমার আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ শুরু হলো, এর পর শুধু আবৃত্তিই নয়, বরং প্রধানত বিভিন্ন নাটকে শিশু চরিত্রের অভিনয়ে নিয়মিত অংশ নিয়েছি। এভাবে আমি দ্রুতই তখনকার সেরা সব অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংস্পর্শে চলে আসি। ওই সময় ফতেহ লোহানী মাঝেমধ্যে রেডিওতে আসতেন। লোকগল্প থেকে ‘আসিয়া’ নামের একটি কাহিনি অবলম্বনে সেই নামেই সিনেমা বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। নায়কের ছোটবেলার চরিত্রে আমাকে অভিনয় করতে বললেন। আমি তখন ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ি। ‘আসিয়া’র নায়িকা ছিলেন সুমিতা দেবী, নায়ক ছিলেন শহীদ। তিনি প্রবাসী। আমার জানা মতে, এর পর তিনি আর কোনো সিনেমায় অভিনয় করেননি। যেদিন শুটিং শুরু হলো, আমার তখন ১০১-১০২ ডিগ্রি জ্বর। জ্বর নিয়েই শুটিংয়ে গেলাম। একটা দৃশ্য ছিল, মেলায় মুখোশ পরা মানুষের অংশগ্রহণে পুতুলনাচ। সেই নাট্যদলের ভেতর একজন ছিলেন কামাল লোহানী। ‘আসিয়া’র সংলাপ রচনায় ফতেহ লোহানীকে কেন্দ্র করে সে সময়কার সব তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিক হাত লাগিয়েছিলেন। অর্থ সংকটের কারণে একে একে দুই বছর পার হয়ে গেল, তবু সিনেমাটির কাজ শেষ হচ্ছিল না। ফলে প্রথম দৃশ্যে আমি যতটুকু লম্বা, দেখা গেল শেষ দৃশ্যে তার চেয়ে একটু বেশি লম্বা হয়ে গিয়েছি। আসলে বাংলাদেশে বাংলা সিনেমার মধ্যে প্রথম শুটিং শুরু হয়েছিল ‘আসিয়া’র; কিন্তু প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিল ‘মুখ ও মুখোশ’। কারণ ওদের টাকা ছিল বলে তাড়াতাড়ি শেষ করতে পেরেছিল। ‘আসিয়া’ই আমার অভিনীত প্রথম ও শেষ সিনেমা। যদিও মঞ্চনাটক ও রেডিওর নাটকে স্কুলজীবনের পুরোটা সময়ই জড়িত ছিলাম, তবে স্কুলের শেষ জীবনটা আমার জন্য ‘অভিনেতা’র পর্ব থেকে ‘ভালো ছাত্রে’র পর্বের সূচনালগ্ন। ভালো ছাত্রের পর্ব থেকে শুরু হলো ‘রাজনীতি’ পর্ব। অনেকে খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘ছিলে অভিনেতা, হয়ে গেলে জননেতা!’

রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হলো কখন?

ষাটের দশকে নামকরা স্কুলগুলোতে স্কাউট আন্দোলন জোরদার হয়েছিল। আমাদের স্কুলের তখনকার বিখ্যাত ‘ফিফথ ট্রুপে’র ট্রুপ লিডার ছিলাম আমি। স্কাউট আন্দোলন করতে গিয়েই সিগন্যালিং, সেতু নির্মাণ, রান্নাবান্না, সাঁতার ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠি। প্রতি মাসেই দু-একবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ট্রুপের সদস্যদের নিয়ে ঢাকার আশপাশের কোনো না কোনো গ্রামে তাঁবু ফেলে ক্যাম্পিং করতাম। অন্যদিকে জুনিয়র রেড ক্রস কর্মী হিসেবে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নিতাম। ১৯৬২ সালে রেড ক্রসের শতবর্ষ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলাম। তখন আমার ১৪ বছর বয়স। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আমিসহ মাত্র দুজন ছাত্র এই ভ্রমণের জন্য মনোনীত হয়েছিল। স্কুলজীবনেই আমার ভেতর দেশপ্রেমের চেতনার স্ফুরণ ঘটে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণকালে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির সঙ্গে হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে দেখা করার সময় আমার পরনে ছিল বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক—স্বদেশি পায়জামা-পাঞ্জাবি। আমেরিকা থেকে ফিরে লন্ডন ও জেনেভায় গিয়েছিলাম। অন্যদিকে শারীরিক পরিশ্রম সব সময়ই আমার ভালো লাগে। ছোটবেলা থেকেই শ্রম ও শ্রমজীবীদের প্রতি সম্মান ও মমত্ব অনুভব করি। বাজারে বা স্কুলে যাওয়া-আসার পথে অনেক সময় মুচির জুতা সেলাই করার কৌশল, ঝালাইকারের দক্ষতা, কাঠমিস্ত্রির নকশা আঁকা ইত্যাদি কাজ তাঁদের পাশে বসে মন দিয়ে দেখতাম। স্কুলজীবনে অঙ্কে প্রায় সব সময়ই ১০০-তে ১০০ পেতাম। ‘সায়েন্স ফেয়ারে’ অংশ নিয়ে একাধিকবার পুরস্কার জিতেছি। স্কুলের অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে একবার ‘জীবনের লক্ষ্য’ রচনায় লিখেছিলাম, ‘বৈজ্ঞানিক হয়ে এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করতে চাই, যা দিয়ে একজন মানুষ ১০০ জনের সমান কাজ করতে পারবে।’ লেখা শেষ হতেই খেয়াল হলো, তাহলে তো অবশিষ্ট ৯৯ জনই বেকার হয়ে যাবে! তখন অনুভব করলাম, দেশের ও মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে হলে শুধু বিজ্ঞানচর্চা করলেই চলবে না, একই সঙ্গে সমাজ ও অর্থনীতি নিয়েও ভাবতে হবে। এরই মধ্যে স্কুলজীবনের নানা ঘটনা ও আমেরিকা সফরের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে একটা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা আমার মনে উঁকি দিতে থাকে।

কোন জিনিসটি আপনাকে পথ দেখিয়েছে?

এসএসসির পরপরই নটর ডেম কলেজের লাইব্রেরি থেকে মার্ক্স-এঙ্গেলসের একটি রচনাসমগ্র এনে পড়তে দিয়েছিলেন মনজুরুল আহসান খান। সম্পর্কে তিনি আমার খালাতো ভাই। সেই রচনাবলিতে থাকা ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ পড়ে মার্ক্সীয় মতবাদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করলাম। এত দিন নিজের ভেতর যে প্রশ্নগুলো জমে ছিল, যে স্বপ্ন নিজে নিজে দেখতাম, সেগুলোর একটা উত্তর ও ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম। এরপরই সুর্দিষ্টভাবে সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ ও মার্ক্সবাদের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। যোগ দিই ছাত্র ইউনিয়নে। ছাত্ররাজনীতির সুবিধার্থেই নটর ডেম কলেজের বদলে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই এবং বাসা ছেড়ে উঠি কলেজ হোস্টেলের ৩০৩ নম্বর রুমে। ১৯৬৫ সালেই কমিউনিস্ট পার্টির গ্রুপে সংগঠিত হয়ে পরিকল্পিতভাবে মার্ক্সবাদের পাঠ নেওয়া শুরু করি। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর গোপন কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ সদস্যপদ পেয়েছি।

এ সময়ে ঢাকা কলেজের পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন স্কুলে ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তোলার কাজ করেছি। বেশ কয়েক বছর ঢাকা মহানগর ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব ছিল আমার কাঁধে। ১৯৬৬ সালে ছাত্র ইউনিয়নের দশম জাতীয় সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হই। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে সহসাধারণ সম্পাদক, পরের বছর সাধারণ সম্পাদক হয়েছি।

কলেজে পড়ার সময়ই প্রথম কারাভোগ করেন?

১৯৬৬ সালের ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় কলেজ থেকে আমাকে বহিষ্কার করা হয়। পরে জগন্নাথ কলেজ থেকে এইচএসসির দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছিলাম। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ছয় দফা দাবিতে আওয়ামী লীগের ডাকা পূর্ণ দিবস হরতালে কমিউনিস্ট পার্টিও সমর্থন দিয়েছিল। পার্টির নির্দেশ ছিল, ‘জনতার সঙ্গে থাকো’। সেই হরতালে পিকেটিং করতে গিয়ে স্টেডিয়ামের সামনের রাজপথ থেকে গ্রেপ্তার হই। এক মাসের কারাদণ্ড দিয়ে আমাকে জেলে পাঠানো হয়। এর পর আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য একাধিকবার কারাভোগ করতে হয়েছে আমাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবন কেমন ছিল?

১৯৬৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হই। মুহসীন হলের ৬৬০ নম্বর রুমে থাকতাম। আমার সাবসিডিয়ারি সাবজেক্ট ছিল পরিসংখ্যান ও সমাজবিজ্ঞান। লেকচার শোনার আগ্রহ থেকে অন্য বিভাগের ক্লাসেও হাজির হতাম, বিশেষ করে দর্শন বিভাগের ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (জে. সি. দেব) ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী স্যারের ক্লাস মিস দিতে চাইতাম না। টিএসসিতে ‘টেলেন্ট শো’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিবছর ডিপার্টমেন্টে প্রথম হওয়া ছাত্রদের পুরস্কৃত করা হতো। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষকই উপস্থিত থাকতেন। ১৯৬৮ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় আমাদের বিভাগে আমি প্রথম হয়েছিলাম। সেই অনুষ্ঠানে একজন শিক্ষক আমার সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এখন আমরা আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব এমন একজনের সঙ্গে যে এবার কলাভবনের সেরা বিভাগের সেরা ছাত্র, যে সারা দিন ক্লাস, নোট, লাইব্রেরি ওয়ার্ক নিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকে, তাকে হয়তো আপনারা চিনবেন না।’ কিন্তু আমি মঞ্চে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। কারণ লোকচক্ষুর আড়ালে থাকব কি, আমাকে তো সবাই ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়ানো ছাত্রনেতা বলে চেনেই! এই ঘটনা আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের এক সুখস্মৃতি হয়ে আছে।

সে সময়ের কিছু কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাই।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে দেশে ব্যাপক জলোচ্ছ্বাস হয়। আমি তখন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে একটানা দেড় মাস নোয়াখালীর চরবাটায় থেকে সেখানকার বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ করেছি। এ সময় পুনর্বাসনের দাবিতে চরবাটা থেকে মাইজদী কোর্ট পর্যন্ত হাজারো মানুষের মিছিল নিয়ে ডিসির অফিস ঘেরাও করেছিলাম। অন্যদিকে মহাসংগ্রামের ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মার্চেই শুরু হয়েছিল আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামের প্রত্যক্ষ প্রস্তুতি। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাইফেল কাঁধে আমাদের এক বিশাল ব্রিগেড বাহিনী খেলার মাঠ থেকে বের হয়ে শহরের প্রধান সড়কগুলোতে সুসজ্জিত প্যারেড সংগঠিত করেছিল। এসব কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো কেমন ছিল?

পঁচিশে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রতিরোধ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে ক্যাম্পাস ধ্বংসস্তূপ ও বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। একসময় আমি ভারতে গিয়ে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর যোদ্ধা হিসেবে বিশেষ গেরিলা ট্রেনিং নিই। প্রথম ব্যাচে ট্রেনিং নিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরে অপারেশন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচুর শিক্ষার্থীকে তখন সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছি। ১৩ ডিসেম্বর ২০০ জনের একটি বড় গেরিলা দলকে কমান্ড করে, অনেকটা ‘ফোর্সড মার্চে’র কায়দায় ঢাকার উপকণ্ঠের শ্রীনগর, দোহার ও কেরানীগঞ্জ থানার সংযোগস্থলের প্রখ্যাত চুরাইন গ্রামে এসে হাজির হই। তার পর নেতাদের সঙ্গে বসে আমরা ঢাকায় ঢোকার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, মাহবুব জামানের নেতৃত্বে একটি ছোট গ্রুপ মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া হয়ে ঢুকবে। আর মূল বাহিনী ঢুকবে আমার নেতৃত্বে, কেরানীগঞ্জ হয়ে। সেই লক্ষ্যে ১৬ ডিসেম্বর ভোরবেলা আমরা যাত্রা প্রক্রিয়া শুরু করি। মার্চরত অবস্থায়ই বিকেলবেলা খবর পাই, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। পরদিন সকালে পুরো বাহিনী নিয়ে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে, হেঁটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসি। সেখানে আমি সহযোদ্ধাদের শপথ করাই। শহীদ মিনারে রাইফেল উঁচিয়ে গেরিলা বাহিনীর শপথ নেওয়ার যে আলোকচিত্রটি খুবই সুপরিচিত, সেটি আমাদেরই। এ দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের এনেক্স ভবনে আমি গেরিলা ক্যাম্প স্থাপন করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে প্রাঙ্গণ থেকে ৯ মাস আগে ‘মুক্তি না হয় মৃত্যু’ শপথ নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম, এভাবে সেখানেই অস্ত্র হাতে বিজয়ীর বেশে ফিরে সবাই একত্র হলাম।

দেশ গড়ার কাজে কিভাবে অংশ নিয়েছিলেন?

‘লাখো শহীদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ, এসো এবার দেশ গড়ি’—এই স্লোগানে গোটা ছাত্রসমাজকে উদ্বুব্ধ করার চেষ্টা করেছি। ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে স্বাধীন দেশের জন্য শিক্ষানীতির প্রস্তাবিত খসড়া রচনার কাজটি হাতে নিলাম। এক মাসের মাথায় আমার নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়ন দেশবাসীর সামনে ‘শিক্ষানীতি কমিটি’র প্রস্তাবনা তুলে ধরল। স্টেডিয়ামে আমাদের সব গেরিলা যোদ্ধার অস্ত্র জমাদানের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র জমা দিলাম। তিন-চার মাসের মধ্যেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্র ইউনিয়নের তিন দিনব্যাপী ত্রয়োদশ জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করলাম। এত বড় ও জাঁকজমকপূর্ণ সম্মেলন ঢাকায় এর আগে কখনো হয়নি। সম্মেলন চত্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ ও কমরেড মণি সিংহের বিশাল প্রতিকৃতি আমরা স্থাপন করেছিলাম। দেশ-বিদেশের অনেক নামি অতিথি সেখানে হাজির হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রধান অতিথি। সেই সম্মেলনেই আমাকে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। এর পরপরই অনুষ্ঠিত হয় ডাকসুর নির্বাচন। সেখানে দুই ছাত্রলীগের প্রার্থীদের সম্মিলিত ভোটের চেয়েও অনেক বেশি ভোট পেয়ে, বিপুল ব্যবধানে স্বাধীন দেশের প্রথম ডাকসু ভিপি নির্বাচিত হয়েছি।

ভিপি হিসেবে আপনার কর্মকাণ্ড কী ছিল?

বিশ্ববিদ্যালয়ের মল এলাকার সৌন্দর্যকরণ, ডাকসু ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা প্রণয়ন, ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্যটি নির্মাণ, শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণ, একুশের প্রভাতফেরির জন্য শহীদ মিনারের সাজসজ্জা ও অলংকরণ প্রভৃতি কাজ করেছি। এ ছাড়া আবাসিক সমস্যা সমাধানের জন্য স্বেচ্ছাশ্রমের সহায়তায় টিনশেড নির্মাণ করে এফ রহমান হল সচলের ব্যবস্থা করেছি। চালু করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট। সেই সিনেটে প্রথম ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিই আমিসহ পাঁচজন। ‘ডাকসু বার্তা’ পত্রিকা প্রকাশ করেছি। প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ‘নাট্যচক্র’। সংগঠিত হয়েছে বড় বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাট্য উত্সব, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। প্রবর্তন করা হয়েছে ‘শিক্ষাবর্ষ সূচনা দিনের’ অনুষ্ঠানমালা। প্রতিবছর সেই দিনটিতে প্রতি বিভাগের শিক্ষক-ছাত্রদের একত্র হওয়া, ছাত্ররা সালাম করে ও ফুল দিয়ে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রদর্শন এবং সামান্য বক্তৃতা শেষে সবাই মিলে শহীদ মিনারে গিয়ে পুষ্পমাল্য অর্পণ—এটাই ছিল অনুষ্ঠানসূচি। বিভাগীয় নোটিশ বোর্ডে সেরা ছাত্রদের ছবি ও নাম টাঙানোর ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছিল। অটো প্রমোশন, নকলপ্রবণতা, পরীক্ষা পেছানোর অন্যায় আবদার—এসবের বিরুদ্ধেও শক্ত অবস্থান নিত ডাকসু। সে জন্য একবার নকলবাজ ছাত্ররা ডাকসু অফিস হামলাও করেছিল!

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে ডাকসুর উদ্যোগে প্রতিদিন হাজার হাজার হাতে রুটি তৈরি করে হেলিকপ্টারের সাহায্যে দুর্গম এলাকায় পাঠানো, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও মুহসীন হল মাঠে ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করে বীজতলা স্থাপন ও বিনা মূল্যে ধানের চাড়া বিতরণ—এসব পদক্ষেপও আমরা নিয়েছিলাম। নিরক্ষরতা দূরীকরণ, ভুয়া রেশন কার্ড উদ্ধার, অধিক খাদ্য ফলাওসহ বিভিন্ন অভিযান পরিচালনার জন্য গ্রীষ্মের ছুটিতে চার-পাঁচ সপ্তাহের জন্য ১০-১২ জনের শত শত ব্রিগেড দেশব্যাপী পাঠিয়েছিলাম। সে বছরেরই ১ জানুয়ারি ‘ভিয়েতনাম সংহতি মিছিলে’র নেতৃত্ব দিয়েছি। সেই মিছিলে পুলিশের গুলিতে দুই ছাত্র মতিউল ও কাদের শহীদ হন; আমিসহ অনেক ছাত্র-ছাত্রীই আহত হয়েছিলাম। স্বাধীন দেশে প্রথম ছাত্র হত্যার সেই ঘটনার প্রতিবাদে আমার নেতৃত্বে এক অভূতপূর্ব আন্দোলন গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর আজীবন ডাকসু সদস্যপদ প্রত্যাহার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অপসারণ, বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা, ইউএসআইএস অফিস স্থানান্তর, ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারে স্বীকৃতিসহ আমাদের প্রায় সব দাবি সরকার মেনে নিতে বাধ্য হয়। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট আমাকে সে দেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি পাঠালে, সদ্য সমাপ্ত রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের শত্রু দেশটির সেই আমন্ত্রণপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সভায় আমি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। ১৯৭৩ সালে প্রথম শ্রেণিতে পাস করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ হলেও, ভালো চাকরি কিংবা অধ্যাপনার সুযোগ না নিয়ে পেশাদার বিপ্লবী ও সার্বক্ষণিক পার্টিকর্মীর জীবন বেছে নিয়েছি। এর মধ্যে ডাকসুর ভিপি হিসেবে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলনেও জড়িত ছিলাম।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন...

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে, এর প্রতিবাদে আমার নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এবং ৪ নভেম্বর ঢাকার রাজপথে প্রথম প্রতিবাদ মিছিল হয়। জেলখানায় চার নেতা হত্যার প্রতিবাদে ৫ নভেম্বর হরতাল আহ্বান করি এবং আন্দোলন এগিয়ে নিই। এ কারণে ১৯৭৮ সালের শেষ পর্যন্ত, একটানা দুই বছর বিনা বিচারে নিরাপত্তা বন্দি হিসেবে আমাকে কারাভোগ করতে হয়। সে সময় প্রায় দুই মাস আমাকে সেনা নিয়ন্ত্রিত বন্দিশিবিরে নির্মম নির্যাতন সইতে হয়েছে। এর পর ১৯৮০ সালে পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসে আমি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হই। এর দুই বছরের মধ্যে পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সংস্থা সম্পাদকমণ্ডলীতে (বর্তমানে প্রেসিডিয়াম) সদস্যের দায়িত্ব লাভ করি। তৃতীয় কংগ্রেসের পর পার্টি আমাকে ক্ষেতমজুরদের নিয়ে কাজ করার দায়িত্ব দেয়। কিন্তু কাজ শুরুর আগেই আমাকে আবারও কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। কারাগার থেকে বেরিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে ঘুরে ক্ষেতমজুর আন্দোলনের নীতি, কৌশল, দাবিদাওয়া ইত্যাদি নির্ধারণ করেছি। আমার উপস্থাপিত থিসিসের ওপর ভিত্তি করে ১৯৮১ সালের ১৮ মার্চ এক সম্মেলনের মাধ্যমে আমারই নেতৃত্বে ‘ক্ষেতমজুর সমিতি’ গঠন করা হয়। এক দশকের বেশি সময় এই সংগঠনের প্রথমে সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতির দায়িত্ব আমি পালন করেছি।

জাতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ কখন থেকে?

১৯৮২ সালের পর থেকেই জাতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আমার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। ১৯৯০ সালে রচিত ঐতিহাসিক ‘তিন জোটের রূপরেখা’র প্রথম খসড়াটি আমিই তৈরি করেছি। এরশাদের শাসনামলে আমাকে একাধিকবার স্বল্প সময়ের জন্য কারাবরণ এবং বহুবার গ্রেপ্তার এড়িয়ে পলাতক থেকে আন্দোলনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে পার্টির নেতৃত্বের একটি প্রধান অংশ বিলোপবাদী চিন্তায় আক্রান্ত হয়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছিল। সেই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পার্টির অস্তিত্ব রক্ষার আন্তঃপার্টি সংগ্রামে আমি নেতৃত্ব দিয়েছি। ১৯৯৩ সালের জুন মাসে বিশেষ সম্মেলন করে বিলোপবাদী নেতৃত্ব অপসারণ এবং পার্টিকে পুনর্গঠন করা হয়। সেই সম্মেলনেই আমাকে পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয়। ১৯ বছর সেই দায়িত্ব পালনের পর ২০১২ সালে আমি পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের দিকে তাকিয়ে নিজের সম্পর্কে মূল্যায়ন?

রাজনীতির রুগ্ণতা দূর করে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনার জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমি এখনো নীতিনিষ্ঠ প্রয়াস চালাচ্ছি। আমি মনে করি, দেশপ্রেমের কোনো একক রূপ নেই। নানা রূপে দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। প্রগতির ক্ষেত্রেও কেউ একচেটিয়াত্ব দাবি করতে পারে না। সুতরাং বহুমাত্রিকতায়, বহু রূপে সেটার প্রকাশ ঘটা সম্ভব। ‘আমি তো ওই কাজটা করতে পারলাম না’—এ ধরনের কোনো দুঃখবোধ থাকা উচিত নয়। যে কাজটা করতে পারলাম, সেটার ভেতর আমার দেশপ্রেম ও প্রগতির মনোভাব প্রতিফলিত হলো কি না, সেই সম্পর্কে সচেতন থেকে কাজ করে যাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।

আপনার ব্যক্তিগত জীবন?

আমি বিয়ে করেছি ১৯৭৯ সালে। স্ত্রী নাসিমা সুলতানা একজন সরকারি কর্মকর্তা। আমাদের মেয়ে স্বর্ণালী ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে ন্যানো টেকনোলজি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নয়ে ফিরে এসেছে। ছেলে তৌহিদুল ইসলাম খান (সুমন্ত) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়ছে।

(পুরানা পল্টন, ঢাকা; ২৪ মার্চ ২০১৯)

আরো পড়ুন -->>

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ