আমার কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার পাঠ
জাহানুর রহমান খোকন
কুড়িগ্রাম নামক ছোট শহরে বসবাস আমার, তাঁর চেয়েও বড় পরিচয় আমি গ্রামের ছেলে, রাজনীতি নিয়ে তেমন কোন দলের পক্ষে বা বিপক্ষে আমার অবস্থান কোনদিন ই ছিল না।
এমন কোন দল পাই নি যারা আমার কথা বলে, আমার অধিকারের কথা বলে, গণ মানুষের দাবি ও তাঁদের অধিকারের জন্য লড়ে তাই কোন দলের সদস্য যেমন আমি হতে যাই নি, কেউ আমাকে তাঁদের করে পায় নি।
এক বড় ভাইয়ের সাথে পরিচয়ের মধ্য দিয়ে প্রথম জানলাম যে আমাদের রাজনীতি জানতে হবে এবং রাজনীতি করতে হবে, সে যে কোন দল ই হোক না কেন? কারণ আমাদের দেশের দ্রবের মূল্য, এমন কি আমি যে পিঁয়াজ খাই তাঁর দাম ও রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। তাই জানার জন্য নিজের অস্থিত্ব যেন কেউ আমার অজান্তে বিকিয়ে না দেয় তাঁর জন্য হলেও রাজনীতি জানতে হবে। তাই তাঁর কাছে প্রথম একটি কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার নামক বইটি নিলাম।
এলাকায় আমি কমিউনিস্টদের বাম বলে গালি দিতে শুনেছি, তাই আগে এই নিপীড়িত সংগঠনটি সম্পর্কে জানতে চাই এবং আমার পাঠ শুরু।
এই কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারটি ১৮৪৭ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্টদের নিয়ে লন্ডনের এক সভায় রচনা করা হয়। ইশতেহারের জন্মের ইতিহাস পুরাতন হলেও এর বাক্য এবং কার্যপ্রণালী, আলোচনার বিষয় এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং সময় উপযোগী যে মনে হচ্ছে এখনকার কথা বলা হয়েছে, এই তো আমার পাশের লোকটির কথা কিংবা আমার কথাই বলা হচ্ছে উক্ত ইশতিহারে, যার ফলে এই ইশতেহারটি এখন ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়েছে।
পৃথিবীর ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস। জাতিতে জাতিতে, ছোটতে ছোটতে আবার ছোটতে বড়তে কিংবা জাতিতে বিজাতিতে এই সংগ্রাম চলছিল প্রতিনিয়ত। এর অর্থ অত্যাচারী ও অত্যাচারিত শ্রেণী সব সময় পরস্পর বিরোধি হয়ে পরস্পরের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, যার ফলে সংগাম সংগঠিত হতো। মধ্যযুগীয় সামন্ত সমাজের পর যে আধুনিক বুর্জোয়া সমাজ সৃষ্টি হয়েছে তাঁর মাঝেও রয়েছে এই সংগ্রামের ইতিহাস। যেমন ভাবে মধ্যযুগীয় অত্যাচার অন্যায়ের ধরণ বদলিয়েছে তেমন ভাবে বদলিয়েছে সংগ্রামের ধরন। মধ্য যুগের সামন্ত সমাজে শিল্পোৎপাদন ছিল একদল লোকের হাতে বন্দি, তাঁরা হলেন গিল্ড কর্তা। যেমন ভাবে হস্ত শিল্পের জায়গা দখল করে নিয়েছে আধুনিক যন্ত্রশিল্প তেমন ভাবে কালের বিবর্তনে গিল্ড কর্তার জায়গায় এলো আধুনিক বুর্জোয়া। অত্যাচারের ধরণ পরিবর্তন হলো, অত্যাচারী পরিবর্তন হলো কিন্তু অত্যাচারিত শ্রমিক শ্রেণী অপরিবর্তিত থেকে গেলো।
ইতিহাসের দিক থেকে এই বুর্জোয়া শ্রেনী বড় একটা বিপ্লবী ভূমিকা নিয়েছিলো, তাঁরা যেখানেই প্রাধান্য পেয়েছে সেখানেই সমস্থ সামন্ত সম্পর্ক, পিতৃতান্ত্রিক সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ভাবে যে শোষণ বৈষম্য যা লোকচক্ষুর অন্তরালে ঢাকা ছিল বুর্জোয়া সমাজে তা নগ্ন করে দিয়ে সকলের সামনে খোলাসা করে দাড় করিয়েছে। শ্রমিক কে করেছে যন্ত্রের লেজুড়। নগদ টাকার হিসেব ছাড়া এই বুর্জোয়া গোষ্ঠী কোন নারী পুরুষেও ভেদাভেদ রাখেনি।
সব ধরণের কুসংস্কার ঝেঁটিয়ে বিদায় করে তাঁদের ঢুকতে হয় সকল জায়গায়, সকল ক্ষেত্রে স্থাপন করতে হয়ছে তাঁদের বাণিজ্য, অবিরাম নিত্য নতুন বদল আনতে হয়ছে তাঁদের উৎপাদিত দ্রব্যের। সকল জাতিকে বাধ্য করেছে তাঁদের পদ্ধতি গ্রহণে, তাঁরা বিশ্ব বাজার দখল করেছে, যার ফলে মানুষ শেষ পর্যন্ত সমাজের ও জীবনের আসল সম্পর্কটা খোলা চোখে দেখতে বাধ্য হয়েছে।
কিন্তু এই সকল উৎপাদন বিকাশের ফলে যেভাবে একদিন সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে গেছে সেই একই কারণে অতি উৎপাদনের দরুন আজ বুর্জোয়া শ্রেনী নিজেরাই নিজেদের প্রতিযোগী হয়ে উঠে, তাঁরা তাঁদের পণ্যের সস্তা বাজার দর করে তোলে এবং উৎপাদন শক্তির বিপুল অংশ নষ্ট করে ফেলে। যার ফলে তাঁদের ধ্বংশের পথ কিছুটা অগ্রসর হয়, আর এই বুর্জোয়া শ্রেণী শুধু তাঁদের ধ্বংসের পথ তৈরি করে না, তাঁদের ধ্বংশ করার হাতিয়ার ধরার জন্য প্রলেতারিয়েতও তৈরি করে রেখে যায় তাঁদের স্বীয় অতি উৎপাদনের ও সস্তা বাজার মূল্যের মহামারীর মাধ্যমে।
এই প্রলেতারিয়েত বাজারের সমস্ত দরদামের সাথে বেচাকেনা হয়, তাঁদের যেন বাজারি দ্রব্যে পরিণত করা হয়, আর তাইতো তাঁরা আস্তে আস্তে রুখে দাঁড়ায় নিজেদের ভাবি প্রভু বুর্জোয়াদের বিপক্ষে। তাঁদের এই লড়াই জন্ম জন্মান্তরের লড়াই। প্রথম দিকে লড়তে থাকে ফ্যাক্টরির বিশেষ বিশেষ মজুরেরা; তারপর লড়ে সুবিধা বঞ্চিত সমস্ত ফ্যাক্টরির মেহনতি জনগণ।
এ পর্যায়ে মজুরেরা, প্রলেতারিয়েতরা থাকে ছত্রভঙ্গ অবস্থায়। তাঁদের না থাকে কোন দল, না থাকে কোন ট্রেড ইউনিয়ন। তাঁদের লড়াই শত্রুর বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় তাঁরা কোন কোন সময় জিতেও যায় কিন্তু এ জয় কোন বৃহৎ শ্রমিক শ্রেনীর জয় নয়, এটা একটা ফ্যাক্টরি বা একটি অংশের কিছু মেহনতি মানুষের জয়, আর তাঁদের এই জয়ের পিছনেও থাকে বুর্জোয়া শ্রেনীর রাজনৈতিক অভিসন্ধি। এই অভিসন্ধির ফলে আবার উপকৃত হয় প্রলেতারিয়েত। তাঁরা দল গঠন করে ফেলে, বিভিন্ন ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের নিয়ে তাঁরা বৃহৎ সংগঠনে রূপ নেয়,বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তোলে, যার ফলে বুর্জোয়া গোষ্টি তাঁদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। আর বিদেশী তাঁদের বুর্জোয়া শ্রেনীর সাথে প্রতিযোগিতা মঞ্চে টিকে থাকার জন্য তাঁরা প্রলেতারিয়েতের কাছে হাত পাতে, তাঁদের টেনে আনে রাজনীতির মঞ্চে, এই অর্থে বুর্জোয়ারাই প্রথম প্রলেতারিয়েত কে রাজনীতি শেখায়। আর এই শিক্ষা পরবর্তীতে প্রলেতারিয়েত আবার তাঁদের স্বদেশী বুর্জোয়াদের হটাতে ব্যবহার করে।
এই প্রলেতারিয়েত সমাজের কোন স্বার্থ নেই, তাঁদের অর্থ নেই, সম্পত্তি নেই, কিন্তু তাঁদের পিছনে ওঁত পেতে আছে বুর্জোয়া সমাজ, এই বুর্জোয়া সমাজের স্বার্থ নিহিত থাকে এই নিচু বুর্জোয়াদের মধ্যে। আর তাইতো এই বুর্জোয়াদের ঝেটিয়ে বিদায় করতে প্রলেতারিয় কে নড়তে হয়, লড়তে হয়। তাঁদের যেহেতু পাওয়ার আশা রয়েছে কিন্তু হারাবার ভয় নেই তাই তাঁরা লড়ে বিরাট সংখ্যা গরিষ্টদের স্বার্থে।
বুর্জোয়া শ্রেণীর আধিপত্যের মূল শর্ত হলো পুঁজি সৃষ্টি ও বৃদ্ধি, আর এই পুজির শর্ত হলো মুজুরি শ্রম, আর মুজিরি শ্রম মানেই এই সমাজের নিম্ন স্তর প্রলেতারিয়েত। সুতরাং যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আজ বুর্জোয়া সমাজ উৎপাদন বৃদ্ধি করে চলেছে তাঁদের ধ্বংসের জন্য সেই যন্ত্রের আধুনিকায়নই যথেষ্ট৷
মোটকথা বুর্জোয়াদের পতন আর প্রলেতারিয়েতের জয় এই আধুনিক যন্ত্র, শিল্প কারখানাসহ উৎপাদনের মাহামারীর মাঝেই নিহত। শুধু তাঁদের একটি পতাকা তলে দাঁড়িয়ে সংগঠিত হবার অপেক্ষা মাত্র।
আরো পড়ুন -->>
4 মন্তব্যসমূহ
সুন্দর লেখা৷ লেখকের চিন্তাগভীরতার ছাপ স্পষ্ট৷ আমারও বইটা পড়তে ইচ্চা হচ্চে৷ পিডিএফ দেয়া যাবে কি ভাই?
উত্তরমুছুনভাই, এ যুগে নিজেই ইন্টারনেটে সার্চ করে যে কোন বই খুঁজে নেয়া যায়, এরজন্য প্রশ্ন করার দরকার কি? এই নেন এখানে সার্চ রেজাল্ট দিলাম । কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার সম্পর্কে আরও কয়েকটি লেখাপত্র পড়ুন আর বিভিন্ন সোর্স থেকে ডাউনলোড করে নিন।
মুছুনখুব সংক্ষেপে অসাধারণ আলোচনা
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
উত্তরমুছুনঅনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্যের দায় মন্তব্যকারীর, সম্পাদকের নয়।