কুশল-রঙের জ্যোৎস্নার আবহেজন্মান্তরিত হবো আমি, হবো জ্যোতিষ্ক-নাগরিক।
একদা যে ধুলোগৃহে আমিও ছিলামকরি আজ অবধান সেই ধুলিধাম।
কোত্থেকে যে আসে ঢেউ! সেই অভিঘাতে প্রথম বিশ্বেরদোষ-ত্রুটি এসে লাগে তৃতীয় বিশ্বে, কুড়িগ্রামের শীতাইঝাড় গ্রামেও।(প্রথম বিশ্বের দোষ-ত্রুটি এসে লাগে শীতাইঝাড় গ্রামেও/ জন্মান্তরিত হবো কোনো নভোগৃহে)
শুশ্রূষা করবে ভেবে ছুটে আসে নার্স। ডেটলবিধৌত দেহ হতেরূপ যেন ছিটকে ছিটকে পড়েচতুর্দিকে। তাকে দেখে মজে পুঁথির কুমার।(ভাসান/ যথা কবি নিরঞ্জন)
পশ্চিমপ্রবণ বায়ু হতে কতো ধর্মযুদ্ধবাণিজ্য সন্ত্রাস এবং নিবিড় মেদের গদ্য ছড়িয়ে পড়ছেফসলের নব-উদ্ভাসিত প্রকরণে।(যথা কবি নিরঞ্জন)
জীবনের শত ব্যর্থতা, হাহাকার, দেশ-কালের লাঞ্ছনাকে আড়াল করতে তিনি ফিরে ফিরে আসেন বাঙলার পুরান পুঁথির কাছে।
এরপর কুড়ি জন বাসযাত্রীর পঞ্চাশটি ভিন্ন ঘটনা প্রবাহ ও আলাপচারিতার গল্প ‘একটি দূরপাল্লার কোচ ও গতির অভ্যন্তরে কিছু বহুভেদক প্রাণ’।
এ বইয়ে কাল্পনিক গল্প নয়, লেখক যেন এই সমাজের দগদগে ঘা সূর্যের আলোতে মেলে ধরেছেন। ফলে এই সমাজব্যবস্থার প্রতিই বিবমিষা তৈরি হতে পারে পাঠকের! লেখক লেখেন, “তথাপি এ কাহিনী শেষ হয় না...”। সত্যিই কি তাই? এ কি সেই গল্প, যে গল্পের শেষ নেই? আর সেজন্যই কি তিনি পরবর্তী বইয়ের নাম দিলেন ‘জন্মান্তরিত হবো কোনো নভোগৃহে’। এটি তাঁর শেষ বই, কবিতার। জয়তী প্রকাশনী থেকে ২০১১ এ প্রকাশিত হয়। এ বইয়ের ফ্ল্যাপে টোকন ঠাকুর লিখেছেন,
কাব্যের সৌন্দর্য নির্মাণে মিজান খন্দকার বাংলা কবিতায় ইতোমধ্যেই এক নিমগ্ন ভাষার জন্ম দিয়েছেন। ... নিরন্তর বদলে যাওয়া বাংলা কবিতার শব্দ-বাক্য-ভঙ্গিতে মিজান খন্দকার একজন সমুজ্জল কবি।
এ বইয়ের অন্দরে প্রবেশ করে আমরা খোঁজ করি সেই নিমগ্ন ভাষার। দেখি সেইখানে প্রেম আর প্রকৃতি মিশে একাকার।
এইভাবে বলো যদি, ধরো যদি বলো, ‘চাঁদের বর্ণনা লেখাশেষ হলেতারপরও কিঞ্চিৎ জ্যোৎস্নাযদি হাতে থাকে দেবো তোমাকেও।’(জন্মান্তরিত হবো কোনো নভোগৃহে)
অথবা-
যে দিকেই যাই, সেই পথ জুড়েদাঁড়িয়ে থাক যে তুমি,তখন তোমাকে যদি ছুঁয়ে দেইহয়ে যাও বনভূমি।বনভূমে আছে নীল জলাশয়বলে গেল এক পাখি,সেই জলে ডুব সাঁতারের ছলেতোমাকেই শুধু আঁকি।(প্রাকৃতিক/ জন্মান্তরিত হবো কোনো নভোগৃহে)
এই বইয়ে আমরা কবিকে আরও নিসর্গপ্রেমীরূপে আবিষ্কার করি। অধিকাংশ কবিতাতেই দেখা যায়, প্রকৃতির প্রতি প্রেম। প্রকৃতির গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটনই যেন তাকে জন্মান্তরিত হতে প্রাণিত করে বারবার। কবিতায় তাই নিত্য উঠে আসে শস্যলুপ্তদিনের কথা, নদী-বন-ধানক্ষেতের কথা, শীত-বৈশাখ-বর্ষা... ঋতুর কথা; আর সেই জলের কথা-
জলের প্রতিভা দেখে বিস্ময়-আবেগে একদিনঅতল কুড়িয়ে তুলে দিকচক্রবালে ফুটে উঠেছড়িয়ে দিয়েছিলাম প্রবল মুগ্ধতা।(ভ্রমণ-৩/ জন্মান্তরিত হবো কোনো নভোগৃহে)
জলের প্রতিভায় বিস্মিত কবি তাই জলের কথা বর্ণনা করেন নানারূপে। আমরাও কবির চোখে জলের অফুরন্ত বিস্ময়দৃশ্য আবিষ্কারে অভিভূত হই-
নিচে জলগৃহ, গৃহতে অফুরন্ত বিস্ময়; সাগর-সংশ্লিষ্টএই দৃশ্যেঢেউ শীর্ষে ক্ষুধা-রঙে কিছু ধানের স্বপ্ন আঁকতেচেয়েছিল যে নাবিক;দক্ষিণ-প্রবণপ্রবল বাতাসের সঙ্গে সংঘর্ষেবিধ্বস্ত হয়েছে তারজলগৃহযান।(ভ্রমণ-২/ জন্মান্তরিত হবো কোনো নভোগৃহে)
জল দ্বারা আলোড়িত কবি তাই শূন্য দশকের শেষ দিকে তার সম্পাদিত লিটলম্যাগের নাম দেন ‘জলগৃহ’। এক ফর্মার এই লিটলম্যাগটির দুইটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ২০১৯ এর জানুয়ারি মাসে সুশান্ত বর্মণের উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় এটি অনলাইনে নবরূপে যাত্রা শুরু করে। অনলাইনে একটি সংখ্যা প্রকাশের পর এটিও আর প্রকাশিত হয়নি। তবে সম্প্রতি তিনি আবার এটি প্রকাশের পরিকল্পনা করছিলেন। শূন্য দশকের শুরুর দিকে তিনি ‘শিলালিপি’ নামে একটি সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করেছিলেন। মূলত নব্বই আর শূন্য দশকের অনেকখানি জুড়ে ছিলো তাঁর শারীরিক সক্রিয়তার কাল। তার পরে শারীরিকভাবে ভেঙে পড়লেন, আগের মতো বাইরে, মঞ্চে, আড্ডায় আসতেন না। নিজেকে অনেকটাই ঘরবন্দী করে ফেলেছিলেন তিনি। নিজের লেখালিখি নিয়েই থাকতেন। আমাদের বাসস্থান কুড়িগ্রামে পাশাপাশি গ্রামে হলেও স্থানীয় সাহিত্য রাজনীতির কারণে ২০১৭-র আগে কখনো সেভাবে আড্ডা দেয়া হয়ে ওঠেনি। অথচ ২০১৭ এ হঠাৎ জেলা পরিষদের সামনে দেখা, সেই দিনই হলো অনেক কথা। আবেগাপ্লুত হলেন তিনি। জানালেন, আর কোনো মফস্বলীয় সাহিত্য রাজনীতির দাসত্ব নয়, আর কোনো বিরতি নয়। কাজ করতে চান নবউদ্যমে। আমার সহযোগিতা চাইলেন। আমিও অবলীলায় সহযোগিতা করতে চাইলাম। এরপর কতদিন ঘোষপাড়া ও কলেজ মোড়ে চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়েছি আমরা! জেনেছি তার কত পরিকল্পনার কথা! সর্বশেষ, নাটক লিখছিলেন কুড়িগ্রামের সেইসব মানুষকে নিয়ে, যাঁরা জীবিকার প্রয়োজনে পরিযায়ী পাখিদের মতো ঘোরে এক জেলা থেকে অন্য জেলায়! সেই নাটক মঞ্চস্থ হবার আলাপও চূড়ান্ত হয়েছিলো প্রচ্ছদের সাথে। কিন্তু তা আর হলো না; করোনায় আমরা হারালাম কুড়িগ্রামের অন্যতম একজন স্মার্ট ও আধুনিক চিন্তার কবিকে।
২৭.৪.২০২১
2 মন্তব্যসমূহ
মিজান খন্দকারকে চিনি না
উত্তরমুছুনসাম্য রাইয়ানের এই প্রবন্ধ পাঠ করে কবিকে জানলাম৷ শোক ও শ্রদ্ধা
শ্রদ্ধা জানাই৷ সাম্যদা আপনি গ্রেট
উত্তরমুছুনএই প্রবন্ধটির দরকার ছিলো৷ কেউ লিখলো না৷ আপনি লিখলেন৷ প্রণাম নিন৷
অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্যের দায় মন্তব্যকারীর, সম্পাদকের নয়।