নাম- আনা ফ্রাঙ্ক, জন্ম জার্মানিতে। ছোট্ট একটি মেয়ে। তেরো বছর বয়স। এই বয়সেই সুন্দর, গভীর সব কথা দিয়ে লিখে ফেলেছে আস্ত একটা ডায়েরি। যে ডায়েরির পাতায় লিপিবদ্ধ আছে তার নিজের বিশ্বাস, ভালোলাগা, যুদ্ধ, নিজের পরিবার এবং আরো অনেক কিছু।
তেরো বছর বয়সী একজন কিশোরী, যার থাকার কথা ছিল —স্কুলে; পৃথিবীর খোলা আলো-বাতাসে। কিন্তু দিনের পর দিন তাকে থাকতে হয়েছে ৪৫০ বর্গফুট আয়তনের একটি জায়গায়। আবদ্ধ হয়ে থাকা লেগেছে বন্দি ঘরে। দিন-সপ্তাহ-মাস-বছর! তার বন্দী জীবনের শেষ ঘটে না। এভাবেই দুই বছরেরও বেশি প্রায় ৭৬১ দিন ধরে বন্দি হয়ে থাকতে হয় একটি আবদ্ধ ঘুপচি ঘরে। হঠাৎ করেই বদলে যায় নিজের চেনা পৃথিবীটা। বরণ করে নিতে হয় ঘুপচি ঘরের নিরাপদ আশ্রয়। কৈশোরকালের সৌন্দর্য উপভোগ করার সময়টাতেই তাকে দেখতে হয় নৃশংসতা আর বর্বরতার বাস্তবচিত্র। কেমন ছিল সেই নৃশংসতা আর বর্বরতার বাস্তবচিত্র? জানতে হলে আপনাকে অবশ্যই পড়তে হবে সেই দুই বছর দুই মাসের দিনলিপি— 'আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি'।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ; বিভীষিকাময় এক অধ্যায়। সেই বিভীষিকাময় অধ্যায়ের অনেক বড় একজন সাক্ষী—আনা ফ্রাঙ্ক। যদি আপনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনিশ্চিত সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা জলজ্যান্তভাবে জানতে চান, উপলব্ধি করতে চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই পড়তে হবে তেরো বছর বয়সের কিশোরীর লেখা সেই ডায়েরি।
আনা ফ্রাঙ্ক তার ডায়েরিতে নিয়মিতভাবে লিখে তখনকার ভয়াবহ দিনগুলো কলমের আঁচড়ে ডায়েরির পাতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। হলোকাস্টের সময় অ্যামস্টারডার্মের সেই ভয়াবহ সময়কে সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে প্রত্যক্ষ করে তুলেছেন৷
ইহুদি ধর্মের হওয়াতে হিটলারের নাৎসী বাহিনীর রোষানলে পড়ে ফ্রাঙ্কের পরিবার। ফ্রাঙ্কের জন্মের সময় জার্মানির মাটিতে মাথা তুলে হুঙ্কার ছড়াচ্ছে হিটলার। যখন এডলফ হিটলার এবং নাৎসি পার্টি জার্মানির উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে তখন আনা ফ্রাঙ্কের পরিবার নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামে চলে আসেন। ইহুদি জনসংখ্যার উপর নিপীড়ন বেড়ে যাওয়ায় আনার পরিবারকে লুকিয়ে থাকতে হয়। আনা ফ্রাঙ্ককে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে বাড়ির পেছনের চিলেকোঠায়। লুকানোর জায়গাটিকে বিশেষভাবে “গোপন অ্যানেক্স” হিসাবে উল্লেখ করা হয়। দীর্ঘ দুই বছরের বেশী সময়— একটি আবদ্ধ ঘরেই সবকিছু। ঘরের জানালা খোলার উপায় নেই। রাতে বাতি জ্বালানো নিষেধ।
দুই বছর ঐ জায়গাতেই থাকা, খাওয়া, ঘুম থেকে ওঠা, টয়লেট সারা, সন্ধ্যে এবং রাত দেখা। বাইরে সারা শহরে নাৎসি বাহিনীর সদস্যরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আকাশ থেকে বোমা বর্ষণ হচ্ছে। বাহিরে বের হওয়ার সুযোগ নেই। ধরা পড়লেই শেষ!
শুরু হলো দিনলিপি লেখা৷ নাৎসি বাহিনী, তার পরিবার, যুদ্ধ, রাজনীতি, প্রেম সবকিছু দিনলিপিতে লিখে রাখা। কিভাবে তার শরীর বদলে যাচ্ছে সেসব বর্ণনাও সে অকপটে লিখে গেছে। অবাক করার মত। মনের সব কথা লিখে গেছে ডায়েরিতে। স্বপ্ন ছিল লেখিকা হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন; স্বপ্নই রয়ে গেছে, বাস্তবায়ন আর হয়নি।
কোনো এক বিশ্বাসঘাতক তাদের ধরিয়ে দেয়। গোপন চিলেকোঠার হানা দেয় নাৎসি বাহিনী। সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় বন্দী শিবিরে। ডায়েরির পাতায় শেষ আঁচড় টানার ঠিক সাত মাস পরে এই পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল আনা ফ্রাঙ্কের। ফ্যাসিস্ট নাৎসীদের নির্মমতার সাক্ষ্য হিসেবে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হয়েছিল তাকে মাত্র ১৫ বছর বয়সে। চলে গেছে সে কিন্তু রেখে গেছে তার কালজয়ী অমর দিনলিপি। আনা আজ বেঁচে নেই কিন্তু আনার লেখা ডায়েরি হাজারো পাঠকের হৃদয়ে বেঁচে আছে। আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি-যার মৃত্যু নেই।
মেয়েটি যেসব কথা দিনলিপিতে লিখেছিল তার থেকে কয়েকটি প্রিয় উদ্ধৃতি—
—'সবকিছুর পরও আমি বিশ্বাস করি, মানুষ তার ভিতরে সত্যিই ভাল।'—'যেখানে আশা আছে, সেখানেই জীবন আছে। এই আশা আমাদের নতুন সাহস জোগায় এবং শক্ত হতে সবকিছুতে সাহায্য করে।'
—'ভাবলে ব্যাপারটা কত চমৎকার যে, আসলে পৃথিবী বদলে দেবার জন্য কারও এক মুহূর্ত অপেক্ষা করার দরকার নেই !'
—'চারিদিকের যে সব সৌন্দর্য এখনও বাকি আছে তা দেখ আর আনন্দিত হও।'
—'আমি লিখতে শুরু করলেই সব ঝেড়ে ফেলতে পারি, আমার দুঃখ দূর হয়ে যায়, আমার সাহস ফিরে আসে।'
—'আমি দুঃখ-কষ্টের কথা ভাবি না, ভাবি যা সৌন্দর্য এখনও বাকী রয়ে গেছে তার কথা ।'
—'যে নিজে সুখী সে অন্যকে সুখী করতে পারে।'
—'আমি দেখেছি, সৌন্দর্য কোথাও না কোথাও শেষমেশ থাকেই । প্রকৃতিতে, সূর্যালোকে, স্বাধীনতায়, নিজের ভিতরে আর এই সৌন্দর্যগুলো তোমাকে সাহায্য করবেই।'
–'শেষমেশ সবচেয়ে উপযুক্ত অস্ত্র হল দরদী এবং মরমী একটি মন ।'
আনা ফ্রাঙ্ক মারা যায় ১৫ বছর বয়সে। মুক্তির ২ মাস, অর্থাৎ ৬০ দিন আগে সে মারা যায়। তার জন্ম ১৯২৯ সালের ১২ জুন এবং মারা যায় ১৯৪৫ সালে।
আনা তার দিনলিপি শেষ বারের মত লেখে ১৯৪৪ সালের ১ অগাস্ট, মঙ্গলবার । কারণ, ঐ দিন তার সাথে থাকা বাকি সাতজন ধরা পরে হিটলার বাহিনীর কাছে ।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, অনুশীলন
0 মন্তব্যসমূহ
অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্যের দায় মন্তব্যকারীর, সম্পাদকের নয়।