যে নৈতিকতা বিপ্লবীদের মেনে চলা উচিত | হো-চি-মিন

অনুবাদ: রতন সেন 


পুরনো সমাজকে পাল্টে দিয়ে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিপ্লব সমাধা করা একটি মহান কর্তব্য। কিন্তু এ কর্তব্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। এজন্য প্রয়োজন হয় জটিল, দীর্ঘকালীন ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের। শক্তি-সমর্থ মানুষেরাই মাত্র কাঁধে বোঝা নিয়ে দীর্ঘ দুরন্তকে পাড়ি দিতে সক্ষম। একজন বিপ্লবীকে অবশ্যই বিপ্লবী নৈতিকতার ওপর আস্থা রাখতে হবে এবং তা থেকেই শক্তি সংগ্রহ করতে হবে। কেবলমাত্র তখনই সে তার গৌরবোজ্জ্বল বিপ্লবী কর্তব্য পূরণে সক্ষম হবে। আমাদের নিজেদের অবশ্যই বদলাতে হবে।

পুরনো সমাজের মধ্যেই আমরা বেড়ে উঠেছি। উত্তরাধিকার সূত্রে পুরনো সমাজ থেকে আমরা যা পেয়েছি তার ভেতর সবচাইতে বিরূপ ও বিপজ্জনক হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। বিপ্লবী নৈতিক-মূল্যবোধের নিরিখে ব্যক্তিস্বান্ত্রবাদ হলো অত্যন্ত ক্ষতিকর একটি প্রবণতা। এই ‘বাদ’ যদি চলতেই থাকে, এমনকি যদি খুব সামান্য পরিমাণেও চলতে থাকে, তবে তা সামান্যতম খোঁচানি পেলেই বেড়ে উঠতে পারে, বিপ্লবীর নৈতিক গুণাবলিকে দমিয়ে দিতে পারে এবং বিপ্লবের জন্য পরিপূর্ণভাবে আত্ম-নিয়োগের প্রয়াস থেকে বিপ্লবীকে বিরত রাখতে পারে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ নিজেই বেশ অনিষ্টকারী এবং তা কপটতাকেও প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। অতীতের জের সমূলে উৎপাটিত করতে হলে এবং প্রকৃত বিপ্লবীর নৈতিক গুণাবলি আত্মস্থ করতে হলে প্রয়োজন অনুশীলনের, নিজেদেরকে শিক্ষিত করে তোলার ও নিজেদেরকে বদলে ফেলার, যা আমাদের অক্লান্ত ভাবে এগিয়ে চলতে যোগ্য করে তুলবে। কেউ যদি অগ্রসর হতে না চায় তবে সে অনিবার্যভাবেই পিছিয়ে পড়বে৷

বিপ্লবীর নৈতিক গুণাবলি দিয়ে কেউ যদি নিজেকে মণ্ডিত করে তোলে, তবে সে সন্ত্রস্ত হবেনা, ধৈর্য হারাবে না, অথবা অসুবিধা কিংবা পরাজয়ের মুখেও পিছু হটবে না। পার্টি, বিপ্লব ও শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থে, জাতি ও সমগ্র মানবজাতির সাধারণ স্বার্থে সে বিনা দ্বিধায় তার ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিলিয়ে দেবে এবং যদি প্রয়োজন পড়ে তবে দ্বিধাহীন চিত্তে ও কোনো প্রকার আক্ষেপ ছাড়াই সে তার প্রাণ বিসর্জন দেবে। একজন বিপ্লবীর নৈতিক গুণাবলির ক্ষেত্রে এটাই হলো সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ। বিপ্লবীর নৈতিক গুণাবলি যার আছে, সে অবশ্যই হবে খোলা মনের মানুষ এবং সাফল্যের মধ্যে কিংবা অনুকুল পরিস্থিতিতেও বিনয়ী। “অন্য সকলের আগে উদ্বিগ্ন হও, অন্য সকলের পরে আনন্দ কর”- বাহাবা পাওয়ার জন্য উদগ্রীব না হয়ে নিজের নিজের কর্তব্যকে কত ভালোভাবে পূরণ করা যায়, তা নিয়েই ভাবনা-চিন্তা করতে হবে। আত্ম-অহমিকা কিংবা আমলাতান্ত্রিকতা দুটোকেই দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। চাল্চুল্ দেখান বা যেকোনো প্রকার নীতিভ্রষ্টতার অবশ্যই ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। বিপ্লবী নৈতিকতার অথবা নীতিবোধের এগুলি যোগ্য অভিব্যক্তি। বিপ্লবের তিনটি শত্রু৷

একজন বিপ্লবী সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের জন্য, শ্রমিক শ্রেণি ও সকল শ্রমজীবী জনতার জন্য সংগ্রামে এমন কোনো প্রচেষ্টা নেই যা সে করবে না। বিপ্লবী নৈতিকতার অর্থ- পার্টি ও জনগণের প্রতি চূড়ান্ত বিশ্বস্ততা। সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম হলো একটি সুদীর্ঘকালীন ও কষ্টদায়ক প্রক্রিয়া। আর এজন্যই প্রয়োজন খাঁটি বিপ্লবের। কেননা, বিপ্লবের শত্রু রয়েছে। বিপ্লবের আছে তিন শত্রু। পুঁজিবাদ-সামাজ্যবাদ খুবই বিপজ্জনক ও অনিষ্টকারক শত্রু। এই হলো প্রথম শত্রু। পশ্চাদপদ রীতিনীতি ও পরম্পরাগত প্রথাগুলি হলো দ্বিতীয় শত্রু। কেননা এরা হলো বিপ্লবের পথে লুক্কায়িত বাধা। এদেরকে মোটেই অবহেলা করা চলে না। এদেরকে বেশ অধ্যবসায়ের সাথেই নির্মূল করতে হবে। যদিও এতে সময় লাগবে। তৃতীয় শত্রু হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, এটি পেটি-বুর্জোয়া ভাবাদর্শ, যা আমাদের সবার ভেতরই এখনও শিকড় গেড়ে আছে। মাথাচাড়া দিয়ে উঠবার জন্য এটি ওঁত পেতে বসে থাকে। প্রথম দুই শত্রুর জন্য এটি হলো পরম মিত্র। সুুতরাং বিপ্লবী নৈতিকতা দাবি করে সকল শত্রুর বিরুদ্ধে দৃঢ় সংগ্রাম, নিরবচ্ছিন্ন সতর্কতা, সংগ্রামের জন্য সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি এবং কোনো অবস্থাতেই শত্রুর কাছে মস্তক অবনত না করা। এভাবেই মাত্র শত্রুকে পরাজিত করা যায় এবং বিপ্লবী কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকা যায় । কথায় ও কাজে ঐক্য পার্টি সদস্যের বক্তব্য ও কাজের মধ্যে যদি ঐক্য না থাকে, তবে সংগঠন একটি বিশৃংখলায় পরিণত হবে- যেখানে যে যার খুশিমত চলছে, ফিরছে, করছে। ব্যাপারটা যদি এরকম হয়, তাহলে জনতাকে নেতৃত্বদান এবং বিপ্লব সমাধা করা একেবারেই অসম্ভব। জনগণের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখেই পার্টি তার নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্তগ্রহণ করে থাকে। সুতরাং বিপ্লবী নৈতিকতা দাবি করে : দ্বিধাহীনভাবে পার্টি নীতি অনুসরণ এবং পার্টি নির্দেশগুলি মেনে চলা অবস্থা যত কঠিনই হোক না কেন, এটা করতেই হবে এবং এভাবেই জনগণের কাছ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে জনগণের প্রেরণা যোগাবে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদকে অবশ্যই দমন করতে হবে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে মুলোৎপাটন করতে হবে বিপ্লবীদের ।

আমাদের পার্টি শ্রমিক শ্রেণি ও শ্রমজীবী জনতার সাধারণ স্বার্থ ফুটিয়ে তোলে। কেননা, কোনো ব্যক্তি বিশেষ কিংবা গোষ্ঠিবিশেষের স্বার্থ দেখা পার্টির কাজ নয়, এটাতো সর্বজনবিদিত। শুধু নিজেদের মুক্তির জন্যই নয়, নিপীড়ন ও শোষণের হাত থেকে গোটা মানবজাতির মুক্তির জন্যই শ্রমিকশ্রেণি লড়াই করছে। এজন্যই সমগ্র জনগণের স্বার্থের সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ মিলে যায়। পার্টির নামে কাজ করে একজন সভ্য শ্রমিক শ্রেণি ও সকল শ্রমজীবী জনতার জন্য কাজ করে থাকে। এবং এ কারণেই একজন পার্টি সভ্যের স্বার্থ অবশ্যই হবে গোটা পার্টি ও শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের অনুকূল, প্রতিকূল নয়। পার্টি ও শ্রমিক শ্রেণির প্রতিটি বিজয় হল প্রতিটি সভ্যেরই বিজয়। একজন লোক যতই গুণাবলি সম্পন্ন হোক না-কেন, পার্টি ও শ্রমিকশ্রেণি থেকে নিজেকে পৃথক করে রেখে, নিজের একক শক্তি দিয়ে সে কিছুই করতে পারবেনা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ফলাফল সকল অবস্থাতেই পাটি সভ্য নিজের চাইতে পার্টির স্বার্থকে উচ্চ স্থান দেবে -বিপ্লবী নৈতিকতার এটাই দাবি। পার্টির সামগ্রিক স্বার্থের সঙ্গে কোনো ব্যক্তিগত সভ্যের স্বার্থের যদি বিরোধ হয়, তবে পার্টির স্বার্থই বলবৎ থাকবে। ভিয়েতনামের পার্টি যখন আত্মগোপনে ছিল এবং প্রতিরোধের যুদ্ধকালে অনেক কমরেড বীরত্বের সঙ্গে জীবনদান করে। এসব সৈনিক ‘উচ্চপদ’ কিংবা ‘সম্মানের দাবি করেনি অথবা পার্টির কাছ থেকে তারা কোনো প্রকার ‘কৃতজ্ঞতা’ প্রত্যাশা করেনি। ব্যক্তিস্বান্ত্র্যবাদকে জয় করতে পারেনি এমন সভ্য আমাদের পার্টিতে এখনও আছে। তারা দাবি করে যে তাদেরকে কাজের জন্য ‘মূল্য’ দেয়া হোক। তারা পার্টির দেয়া ধন্যবাদের জন্য অপেক্ষা করে। তারা দাবি করে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, উচ্চপদ ও সম্মান। তাদের দাবি যদি পূরণ না হয় তাহলে তারা এই বলে পার্টিকে গালমন্দ দেয় যে- ‘পার্টি তাদেরকে ঠিক ঠিক উন্নতি লাভের সুযোগ দিল না.. পার্টি তাদের স্বার্থকে একবারেই উপেক্ষা করল’। ক্রমে ক্রমে এরা পার্টি থেকে দূরে সরে যায় এবং শেষ পর্যন্ত পার্টি-নীতি ও পার্টি শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে চলে যায়। তারা অন্যের সমালোচনা করে কিন্তু নিজেরা সমালোচিত হতে চায় না। তারা আত্ম-সমালোচনায় পরান্মুখ, অথবা কিছুটা করে বাত্ -কি- বাত্ হিসেবে। তাদের আশঙ্কা হলো এই যে, আত্মসমালোচনার পরে তারা সম্মান ও কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলবে। তারা জনগণের মতামতের প্রতি কর্ণপাত করে না। তারা বুঝতে চায় না যে, ভুল থেকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভুলের জন্য আমরা আতঙ্কিত বোধ করি না, কিন্তু সবার জন্য আতঙ্কের কারণ হবে এটাই -ভুল করবার পরে সেটা শুধরে নেয়ার জন্য আমরা যদি সিদ্ধান্তগ্রহণ না করি৷

ব্যক্তি সমষ্টি এবং সমাজ ব্যক্তিস্বান্ত্র্যবাদ মোকাবিলা করাকে ‘ব্যক্তি-স্বার্থকে পদদলিত’ করার সাথে এক করে দেখাটা ভুল হবে। প্রত্যেক ব্যক্তির তার নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে, আছে চমৎকার গুণাবলি। আছে তার নিজস্ব ও পারিবারিক জীবন। ব্যক্তিস্বার্থ যদি সমষ্ঠির স্বার্থে অন্তরায় হয়ে না দাড়াঁয়, তাহলে ব্যক্তিস্বার্থে মন্দ কিছু নেই। সমাজতন্ত্রই প্রতিটি মানুষকে তার ব্যক্তিজীবনের অবস্থাকে উন্নত করে তোলে এবং ব্যক্তিচরিত্র ও ব্যক্তির গুণাবলিকে বিকশিত করে তুলতে সক্ষম। বিপ্লবী নৈতিকতা আকাশ থেকে পড়ে না। দৈনন্দিন কঠোর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিপ্লবী নৈতিকতা বিকশিত হয় ও শক্তি সঞ্চয় করে। হীরক খণ্ডের মত যত সময় ধরে একে ঘষামাজা করা যাবে ততই এটা উজ্জল থেকে উজ্জলতর আলোক দান করবে। এটা সোনার মত। যতই আগুনে পোড় খাবে ততই এটা খাঁটি থেকে অধিকতর খাঁটি হবে। মানবজাতির দাসত্ব মোচনে যথাযোগ্য অবদান রাখতে একজন প্রকৃত বিপ্লবীর নৈতিক গুণাবলি নিজের মধ্যে পরিপুষ্ট করে তোলার কর্মদক্ষতার চাইতে অধিকতর উত্তম আর কিছু নেই।
আরো পড়ুন -->>

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ