গল্পঃ বাণিজ্যের রকমফের | আব্দুল খালেক ফারুক


এক.
    বাজারের মাঝখানে জটলা দেখে এগোয় মতি। দু’পক্ষের মধ্যে কোন গুরুত্বর বিষয় নিয়ে সম্ভবত তুমুল লড়াই চলছে। সমানে হাত উঠছে, পিঠের উপর পড়ছে। কী নিয়ে এ কুরুক্ষেত্র। সুত্র কী কে জানে। মতি বিষয়টি আমলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সজোরে হাঁটা দেয় অকুস্থলের দিকে। কাছে গিয়ে দেখলো লড়াই বেশে জমে উঠেছে। একজন মধ্য বয়সীর নাক দিয়ে দর দর করে রক্ত ঝরছে। ভারী ঘুষির পরিণতি। অন্য একজনের লুঙ্গির গিঁট প্রায় খুলে যাচ্ছে। অথচ সেদিকে ভূক্ষেপ নেই। বরং দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে ঘুষি পাকিয়ে মারতে যাচ্ছেন প্রতিপক্ষকে। পেছন থেকে কে একজন তাকে ধরে ফেলায় জোস আরো বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। 
   
    একসময় এক ঝটকা দিয়ে কোমর টেনে ধরা লোকটাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে ঘুষি মারতে গেলেন যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতিপক্ষের দিকে। এ সময় তড়িৎ কর্তব্য স্থির করে মতি দু’জনের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। ঘুষি লক্ষ্যচ্যূত হয়ে মতির নাক বরাবর আঘাত হানলো। অত:পর নাক ফেটে রক্তপাত। জাতিসংঘ জাতীয় একজনের নাকে রক্তধারা দেখে বিবাদমান দু’টি পক্ষই হকচকিত। ফলে সংঘর্ষের সুর গেল কেটে। সমবেত জটলায় হায় হায় রব উঠল। 
পরোপকারীর এই পরিণতি দেখে সবাই আফসোস করলেও মতি তখন হাসছে। ঠোঁটে বিস্তৃত হাসি ঝুলিয়ে নির্বিকারভাবে বলছে- না তেমন লাগেনি। 
    আসলে মতির জন্যতো এটা নতুন কোন ঘটনা নয়। আগে অনেকবার এরকম হয়েছে। ঝগরা মারামারি থামাতে গিয়ে শহীদ না হলেও গাজী হতে হয়েছে অনেকবার। এতে অবশ্য মতির কোন আফসোস নেই। মানুষের বিপদ দেখলে নাকি সে স্থির থাকতে পারে না। তার ধারণা, বিপদ আর মুশকিল আসানের জন্য খোদাতালা দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন তাকে। 

   কাজেই মারামারি লাগলেই তিনি দু’পক্ষের মাঝখানে দাঁড়াবেন, শরীরের যে কোন অঙ্গে আঘাতপাপ্ত হবেন- এটাই যেন তার নিয়তি। এবারে নাকের উপর দিয়ে একটা প্রমাণ সাইজের লক্ষ্যচ্যূত ঘুষি সপাটে আঘাত হানলে মোটেই অবাক হননি মতি। ঘাবড়েও গেলেন না। বরং এতক্ষণ ধরে সমবেত নাদান জনতা যে ঝগড়া দৃশ্য উপভোগ করছিল, তাদের চেয়ে নিজেকে শ্রেয় মানুষ মনে হয় তার। মতির নাকের উপর দিয়ে ঝড় যাবার পর ঝগরাও থেমে গেল নাটকীয়ভাবে। 
তা এবারের হুজ্জত হাঙ্গামার বিষয়টা কি?
    বিষয় আর কিছু নয় চোরাচালান। একজন চোরাকারবারী আর একজন পুলিশের লাইনম্যান। লাইনম্যান জহির বলছে তুই এ মাসের লাইন দেসনি। চোরাকারবারী মতিন বলছে- লাইন দিয়ে টোকেন নিয়েছি। কাজেই আমার আমার মালামাল পারাপার হবে নির্বিঘেœ। পুলিশের নিযুক্ত ইজারাদার বলে জহিরের একটু বাড়তি তেজ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই মতিনের উপর পহেলা চড়াও হয়েিেছল জহির। এ নিয়ে বিবাদ। 
    মতি ভাবে বর্ডার এলাকায় এই এক সমস্যা। চোরাচালান ব্যবসা নিয়ে কত কিসিমের যে দালালের আবির্ভাব হয়। লাইনম্যান, পাইলট- কত হরেক নামে তারা পরিচিত। ফুলপুর বাজারের ডানপ্রান্তে সরকারি নলকূপে নাক মুখ ধুয়ে নিল মতি। তখনও নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। জীবন ফার্মেসী নামে একটা ফার্মেসীতে গিয়ে তুলা দিয়ে স্যাভলন লাড়িয়ে দিল ক্ষতস্থানে। রক্তপাত কমে গেল। সে রওয়না হলো কলেজের দিকে।  
দুই.
    ফুলপুর ডিগ্রি কলেজের ক্যাম্পাসে ঢুকতেই ছাত্র ছাত্র ভাব এস গেল মতির মধ্যে। সে যে এখনও ছাত্র মাঝে মাঝে তা ভুলেই যায়। বই পুস্তকের সাথে যোগাযোগ না থাকলে এরকম হওয়াই স্বাভাবিক। তিন দফা চেষ্টা করে এসএসসি, আর চার দফায় এইসএসসি পাশ করে চেহারায় আদু ভাইর টাইপের গেটআপ এসে গেছে। ‘বই এলার্জি’ এখন পুরোদস্তুর কাবু করেছে তাকে। সর্টকার্টে পাশের চিন্তা এখন তার মাথায়। রবার্ট ব্রুস বা আদু ভাই কোনটাই হবার ইচ্ছে তার নেই। ফলে অনুসন্ধান চালাতে চালাতে এই কলেজটিকেই বেচে নিয়েছে সে। 
   প্রিন্সিপ্যালের কক্ষে ঢুকতে তাকে বেগ পেতে হলো না। রুমের সামনে কোন প্রহরী নেই। গটগট করে ভেতরে ঢুকেই লম্বা সালাম দিল সে। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব সম্ভবত সালামের আওয়াজ শোনেন নি। তাই প্রত্যুত্তর দিলেন না। তিনি মগ্ন হয়ে পরাটা খাচ্ছেন। পরাটা ছিঁড়ে আলুর ডাইলে চুবিয়ে তড়িৎ মুখে চালান করছেন। বেচারাকে বেশ ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে। এখন দুপুর বারটার সময় নাস্তা খাচ্ছেন, বেশ ব্যস্ত মানুষ মনে হচ্ছে। 
   আসলে ব্যাপরটা তা নয়। এলাকায় কয়েকদিন হলো যাত্রাপালা এসেছে। ‘দি নুরজাহান অপেরা পার্টি যাত্রাগান’। কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি যাত্রার দলটিকে বায়না করে এনেছেন। গতরাত্রে ছিল স্পেশাল শো। থানার ওসি ময়েজ সাব নিজেই অভিনয় করেছেন। পালার নাম ছিল ‘সাজানো বাগান’। সামাজিক পালা। এলাকার বর্তমান চেয়ারম্যান রইচ উদ্দিন, সাবেক চেয়ারম্যান বাদল মিয়াও দুর্দান্ত অভিনয় করে তাক লাড়িয়ে দেন দর্শকদের। জমজমাট এই পালা দেখার জন্য দর্শকদের উৎসাহেরও কমতি ছিল না। ম্যাজিস্ট্রেট আমীর হোসেনকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল যাত্রা দেখার জন্য। তিনি এসেছেন এইচএসসি পরীক্ষার ডিউটিতে। কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি রইচ উদ্দিনের আমন্ত্রণে প্রিন্সিপ্যাল নিজেও যাত্রার দর্শক হয়েছিলেন কাল। অভিনয়ের ফাঁকে ফাঁকে এক ঝাঁক ডানা কাটা পরীর নাচ ছিল বাড়তি আকর্ষণ। এই বান্দরগুলো একেবারে খুল্লাম খুল্লা টাইপের নাচে ধরাশায়ী করেছেন বয়স্ক দর্শকদেরকেও। প্রিন্সিপাল অবশ্য নিজেকে বয়স্ক ভাবে না, ভাবেন ২৫ বছরের যুবক। 
মতি আবার সালাম ঠুকল স্যার সালামুআলাইকুম। ঘুম জাগা টকটকে লাল চোখ মেলে প্রিন্সিপ্যাল বড় অবহেলায় সালামের প্রত্যুত্তর দিয়ে বলেন-
‘তুই কায়রে। কি চাইস’। 
‘স্যার ডিগ্রিতে ভর্তি হতে এসেছি’। 
‘আসপুতো। মুই যে শালা সমন্দির ঘরে জন্যে পাশের দোকান খুলি বচ্চোং’। 

 মতি প্রমাদ গোণে। প্রিন্সিপ্যাল সম্পর্কে সে যতটুকু খোঁজ খবর নিয়েছে তাতে জেনেছে , তিনি খুব দিলখোলা লোক। মুখের ভাষাটা একটু কদর্য। তবে দিলদার আদমী। অধিকাংশ সময় কথা বলেন আঞ্চলিক ভাষায়। কখনও প্রমিত বাংলার সাথে মিশিয়ে। বেশ হিউমার আছে তার কথাবার্তায়। 
‘ স্যার বোঝেনইতো এখানে কেন এসেছি। আমার এক চাঞ্চে পাশ দরকার’। 
‘হ্যা- সগাইতো তাই চায়। দেখিস না দক্ষিণবঙ্গ থাকি কত চোতমারানির ঘর এটে আসি ভর্তি হইছে। শালারঘর বড় লোকের ছাওয়াতো। টাকা কোন সমস্যা না। তা মাল পানি কত আনছিস’। 
‘ স্যার দুই হাজারের মত’। 
‘ মাত্র দুই হাজার। তুই মোর রেট ফেলে দিবার চাইস নাকি?
আরো পড়ুন -->>

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ