সাঈদ বিলাসের ছোটোগল্প :: মাঠ

বেলা শেষ। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আকাশের গায়ে জায়গায় জায়গায় থোক থোক কালো মেঘ বাতাসের গতির সাথে নিজের শরীর ছেড়ে দিয়ে নিজের গন্তব্যে ছুটে চলেছে; মাঝেমধ্যে সাদা মেঘ আর কালো মেঘ পরস্পরকে ঢেকে দেবার লুকোচুরি খেলা খেলছে। মেঘের শরীর একেক সময় একেক আকার ধারণ করছে। উপরে মেঘের খেলা, আর নিচে পাখিদের বাড়ি ফেরা। প্রতিদিনই এটা চলতে থাকে। মাঠের শেষ মাথায় রেইনিট্রি গাছটায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় এই সময়টায় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসে। অসমতার সমীকরণ মেলাতে না পেরে প্রতিদিন শেষ বেলায় মাঠের নরম দূর্বাঘাসের শরীরে নিজের শরীর এলিয়ে দিয়ে মানিক বাবু এইসব দৃশ্য দেখতে থাকেন। ছেলেপেলেরা ফুটবল খেলা শেষে  মাঠের মাঝখানে গোল হয়ে বসে পড়ে। নানা ধরনের এনালাইসিস হয় এই আলোচনায়; কে ভুল পাস দিলো, কার গতি কম ছিল, কার মুভমেন্ট একদম পারফেক্ট ছিল, কার ভুলের কারণে একদম জেতা ম্যাচটা হেরে গেলো দল; এইসব আলাপ চলতেই থাকে, মাঝেমধ্যে আলাপ তর্কে চলে যায়, তর্ক থেকে হাতাহাতিতেও গড়ায় কখনো; তখন একটা হট্টগোল লাগে, লোকজন জড়ো হয়। গাছ থেকে কিছু পাখিও উড়ে যায় তখন, গভীর মনোযোগ দিয়ে ঘাস খাওয়া বাদ দিয়ে গরু দুইটা হয়তো দৌড়ও দেয় ভয় পেয়ে। প্রতিদিন কয়েকটা গরু ঘাস খায়, কোনোটা নিবিড় দৃষ্টিতে কোনো একদিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকে। মানিক বাবুও তাকিয়ে থাকেন প্রায়ই, নানান দিকে তার মনোযোগ; তিনি খেয়াল করেন আজকে কোন গরুটা আসে নাই, কোন ছেলেটা গতকাল মাঠে ছিল কিন্তু আজকে নেই, পাখির ঝাঁক দেখে অনুমান করার চেষ্টা করেন আজকে পাখি বেশি নাকি কম! মাঠের কোণায় একটা বয়স্ক নেড়ি কুকুর শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করে মহাকালের আয়নায় হারিয়ে যাবার। কুকুরের গোঙানির আওয়াজ মানিক বাবু মনোযোগ দিয়ে শোনেন, যেনবা ওর ভাষাটা রপ্ত করার চেষ্টা করছেন, ওর কথাগুলো বুঝতে চান। মাঠে না আসা ফুটবলার ছেলেটি কিংবা না আসা গরুটি কিংবা নীড়ে ফিরতে না পারা পাখিটির জন্য এক ধরনের বেদনা অনুভব করেন তিনি। কোনো কোনোদিন বেদনার তীব্রতা বেশি হলে সময়ের হিসেব তার মনে থাকে না, মাঠের ঘাসের শরীরে শুয়ে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়, মাঠের সকল অস্থায়ী বাসিন্দা যার যার গন্তব্যে ফিরে যায়, মশার কামড় ও সঙ্গীতের একটানা অত্যাচার সহ্য করে শুয়ে থাকেন মানিক বাবু। এই যে সবাই চলে যায়, কোথায় যায়? যে গন্তব্যে যায়, সেটা কি স্থায়ী নাকি অস্থায়ী? কারও কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে নাকি আসলে? কোন ঠিকানায় যায় সবাই? এইসব ভাবতে ভাবতে সমীকরণ সমাধানের কথা ভুলে যান তিনি। 
বহুকাল আগে মাটির সাথে যুদ্ধ করে মাটির বুক চিড়ে জন্ম নিয়েছিল যে গাছ, তা আজ মাটির সাথে বন্ধুত্ব করে সটান দাঁড়িয়ে থাকে, ডালপালা ছড়ায়, ডালে ডালে কথা কয়, মাটির গর্ভে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে যায়। কোথাকার কোন আরেক মানিকের কথা মনে পড়ে মানিক বাবুর! এইরকম কোনো মাঠের কোলে হয়তো শুয়ে থাকেন কী থাকেন নি সেই মানিক। শক্ত মাটির বুকে কোদাল আর লাঙল চালিয়ে পানি ছেঁচতেন সারা দুপুরবেলা। ক্ষুধা লাগলে গরু দুইটারে গাছের ছায়ায় বেঁধে রেখে এসে, মাঠের আইলে বসে পোড়া শরীরে তীব্র রোদের খানিক ভালোবাসা মেখে ডাল-আলু ভর্তা, কোনো কোনো দিন হয়তো মাছ কিংবা মাসে একদিন খানিক গোশতের সুরুয়া দিয়ে নিবিষ্ট মনে আদবের সাথে খেয়ে যেতেন মানিক শেখ। যেনবা খাওয়াটা একটা ইবাদত। খাওয়া শেষ করে কানে গুঁজে রাখা আজিজ বিড়িটা জ্বালিয়ে চোখ বন্ধ করে ভেজা মাটির বুকে ঝড় তোলার কথা ভাবতেন। বিড়িতে টান দিতে দিতে গত কয়েক বছরে ধানের দামে লস খাইতে খাইতে দিব্যি লোন আর সুদের বোঝা বাড়ার কথা মনে হইতো কোনো কোনো দিন। কখনো কখনো ছেলে আর মেয়েটার মুখ ভেসে আসতো দিব্যি সিনেমার মতোন, বউয়ের মুখও ছবির মতো দেখতে পাইতেন কদাচিৎ। নিজের গতর খাটায়া মাটির বুক চিড়ে শস্যের শিল্পকলা ফুটিয়ে তোলা এই শিল্পী মানিক শেখ সোনালু গাছের নিচে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে নেবার সময় এইসব দৃশ্য দেখতে পাইতেন তন্দ্রায়! তন্দ্রা কেটে গেলে রাস্তায় তাকায়া স্কুল ফেরত  মেয়েদের মাঝে নিজের মেয়েটারে খুঁজতেন প্রতিদিনই, স্কুল থেকে ফেরার পথে খাবারের গামলাটা হাতে করে বাড়িতে নিয়ে যেতো মেয়েটা। এটা প্রতিদিনকার রুটিনে পরিণত হইছিল তাদের জন্য। খুব বেশি কথা হইতো না বাবা মেয়ের মধ্যে; ভালোবাসা প্রকাশের বাহুল্য জানা ছিল না বাবার, আর মেয়েরও আদর পাবার আলগা আলঙ্কারিক চাহিদা তৈরি হয় নি। জীবন তাদেরকে এই অলিখিত শর্তে যেনবা বেঁধে ফেলেছে। কাজের ছুঁতোয় প্রতিদিন এই ক্ষণিকের দেখাই তাদের সহজাত ভালোবাসার প্রকাশ হয়তোবা! স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার ধরণটাও হয়তো প্রকাশের চেনা সীমানায় বাঁধা যায় না। সারাদিন জমিতে কাজ করে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে হয়তো বিকেল হয়ে যেতো মানিকের। গরু, লাঙল রেখে ঝামা লইয়া পুকুরে নামতেন তিনি। বউ তখনো কোনো না কোনো কাজ করছেন, হয়তো তাদের দেখাই হলো না, ছেলেটা স্কুল থেকে ফিরে এসে মাচা থেকে ভাতের হাঁড়িটা নামিয়ে নিয়ে যা পাইতো তাই দিয়ে হয়তো গোগ্রাসে গিলে খাইতো, তরকারি না থাকার আলগা দুঃখে মন খারাপ করে থাকার বাহুল্য হয়তো তার ছিল না। সব কাজ কাম সাইরা গোসলে যাইতেন মানিকের বউ, সারা শরীরে শুকনো কলার গাছ পুড়িয়ে বানানো ক্ষার গায়ে মাখতেন, পুকুরের পানির সাথে শরীর ভিজিয়ে সারাদিনের ক্লান্তি ঝেড়ে রাতের কাজের মানসিক প্রস্তুতি হয়তো সারতেন। প্রয়োজন ছাড়া মানিক শেখের সাথে আলগা শব্দ খরচ করার পিরিতি তিনি কখনো করেন নাই, মানিক শেখের দিক থেকেও ব্যাপারটা তাই। বেঁচে থাকবার প্রয়োজনীয় প্রয়োজনীয়তাই হয়তো তাদেরকে কখনোই আলগা শব্দ খরচ করবার বাহুল্যের দিকে যাইতে দেয় নাই, অথচ উভয়েই জানেন দুইজন দুইজনের জন্য কতটা অনুভব করেন নিজেদের, বেঁচে থাকবার নানাবিধ শর্তই তাদেরকে আঠার মতোন একসাথে রেখেছে প্রকাশের আলগা বাহুল্যবর্জিত ভালোবাসায় জড়িয়ে। কখনো কখনো হঠাৎ হয়তো আনন্দের হল্লা বয়ে যেতো মানিক শেখের পরিবারে! হয়তো কোনোদিন বাজার থেকে সস্তায় বড় ইলিশটা কিনে নিয়ে অনেক রাইতে বাড়ি ফিরতো মানিক শেখ। বউকে ডাক দেবার সাথে সাথেই উঠে আসতেন, যেনবা রেডিই ছিলেন উঠে আসার জন্য, যেনবা জানতেন আজকে তাকে উঠতেই হবে এই সময়। তয় মাছের থলিটা হাতে পাইলে চোখ দুইটা খুশিতে জ্বল জ্বল করতো, স্বামী-স্ত্রী উভয়ই হাসিতে নিজেদের খুশির ব্যাপারটা জানিয়ে দিতেন পরস্পরের দিকে তাকায়া, শব্দ খরচের বাহুল্য ছিল না। হয়তো খাবার পরে দুই চারটা আলগা শব্দ খরচ হইতো শোয়ার পর, সেইটাও প্রয়োজনীয় প্রসঙ্গের বাইরের কোনো আলাপ বইলা ঠাওর করা যাইতো না। যৌনজীবনের দিক থেকেও দেখতে গেলে তাদের আলগা কোনো বাহুল্য করবার কসরতের দরকার পরতো না, তেমনি প্রতিদিনকার জীবনের ঝুট ঝামেলা তাদের বিছানায় পেইন হিসেবে আসতো না, যৌনতাকেও জীবনের আর আট দশটা সহজাত অনুভূতির মতোন তারা যাপন করতেন। ছেলেমেয়েদের লালন পালনের ক্ষেত্রে তাদের উভয়েরই মত প্রায়ই একই ছিল। এভাবেই বছরের পর বছর কেটে যায়, শ্রমে-বিশ্রামে নিরুপদ্রব। কিন্তু জীবন জীবনের চলমান গতির সাথে, বাইরের দৌড়ের সাথে তাল মিলাইতে না পেরে কখনো কখনো এই নিরুপদ্রব জীবনে উপদ্রপের আর সীমা থাকে না। দিনের পর দিন ঋণের বোঝা নিয়ে চাষের প্রতি শৈল্পিক ভালোবাসা প্রকাশের সকল উপায় বন্ধ হয়ে যায়। চূড়ান্ত আঘাতটা যখন আসে তখন ঘটিবাটি সব বেচে এতদিনের সহজাত জীবনটাকে মাটি চাপা দিয়ে ভিন্ন বাস্তবতায় জীবনের নতুন সহজাত উপাদান খুঁজবার এক অনন্ত সংগ্রামে পাড়ি জমায় মানিক শেখ ও তার পরিবার। পেছনে পড়ে থাকে শক্ত মাটির বুক ছিনে ছিনে নরম করে ফেলবার আনন্দ-বেদনা কিংবা বিগত যাপিত জীবন। 
কখনো দেখা না হওয়া মানিক শেখের কথা কেন মনে আসে মানিক বাবুর! কেন এতটা ব্যথা লাগে তা বুঝতে পারেন না মানিক বাবু! তাহলে কী তাদের মধ্যে কোনো ধরনের লিঙ্ক আছে! জগতের সকলের সাথেই হয়তো সকলের কোনো না কোনো ধরনের সাধারণ কানেকশন আছে, যা সামষ্টিক অভিজ্ঞতা হিসেবে ব্যক্তির জীবনে একান্তভাবে ধরা দেয় হয়তো। কোথাও বাঁশির করুণ সুর বেজে উঠলে সেই সুর কেন অসংখ্য অচেনা মানুষের বুকে ব্যথার ঝড় তোলে? পৃথিবীর আরও বিভিন্ন জায়গায় হয়তো মানিক বাবুর মতোন আরও অসংখ্য মানুষ মাঠের ঘাসে শুয়ে শুয়েই জীবনের নানান অভিজ্ঞতার কাছে নিজেকে ঝালিয়ে নিচ্ছেন! এই অসংখ্য মানুষের সবাই হয়তো মানিক বাবু না, আবার একদিক থেকে দেখলে সবাই এক একজন মানিক বাবু। সবার গল্পটা মানিক শেখের মতোন না হইলেও অসংখ্য মানিক শেখের আখ্যানই পুরো পৃথিবীর আখ্যান আসলে, শুধু বা নির্দিষ্টকরণের বাস্তবতা ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু সাধারণীকরনের সূত্র কম বেশি হয়তো একই। এইসব ভাবতে ভাবতেই অসম সমীকরণের কথা আবার মনে পড়ে মানিক বাবুর, সমীকরণটা মিলবে কিনা এই দ্বিধা-দ্বন্দে রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বহুকাল আগে জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া এক শাখা-সিঁদুরের আখ্যান ভেসে ওঠে আর সাথে সাথে নেড়ি কুকুরটার আর্তনাদের ভাষাটা কানে বেজে উঠলে একই সাথে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও হতবিহ্বল হয়ে রাস্তার মাঝখানেই বসে পড়েন মানিক বাবু। খানিক সামলে নিয়ে আবার সোজা দৌঁড় দেন মাঠ বরাবর, যেনবা ওই মাঠে কোনো হারিয়ে যাওয়া এক গোপন আকরিক খুঁজে পেয়েছেন তিনি, ঠিক খুঁজে বের করবেন সেই অমূল্যবান আকরিক।


…………………………………………………………
ঊন মানুষ
সাঈদ বিলাস
প্রকাশকঃ উৎস পাবলিশার্স 
বইঃ ৬ ফর্মা
লেখকের গল্পের প্রথম বই। 
এই মাসেই প্রকাশিত হচ্ছে।
বই পাওয়া যাবে কনকর্ডে জাগতিক প্রকাশনীর দোকানে, আজিজে প্যাপিরাসে, বাংলাবাজারে উৎস পাবলিশার্স এর দোকানে, রকমারিতে অথবা লেখকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে।
আরো পড়ুন -->>

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. সাম্য সাইফুল১০/৭/২২, ৮:৩৯ PM

    আহা! অনেকদিন পর একটা গল্প পড়ার অভিজ্ঞতা হল৷ সম্পাদককে ধন্যবাদ৷ লেখকের জন্য রইল ভালবাসা৷

    উত্তরমুছুন

অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্যের দায় মন্তব্যকারীর, সম্পাদকের নয়।