জলে কুমির ডাঙায় বাঘ | মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

অনেক আগেই, আশির দশকের শুরুর দিক থেকে, এদেশে বেজে উঠেছিল সাম্প্রদায়িক জঙ্গিশক্তির ভয়ার্ত উত্থানের বিপদ সংকেত। জামায়াত-শিবিরের রগ কাটা ও গান পাউডার দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে ঘটেছিল তার সূত্রপাত। কিন্তু সেই বিপদ সংকেতকে তখন যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ‘এক দফা এক দাবি– এরশাদ তুই করে যাবি’ শ্লোগানে মনযোগ কেন্দ্রীভূত করে রাখার চেষ্টা হয়েছিল। ফলে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। এই দানবীয় শক্তি বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিল।

এই অপশক্তির হাত থেকে প্রথম বড় আঘাতটি এসেছিল ১৯৯৯ সালে যশোরে অনুষ্ঠিত বামপন্থী ঘরানার প্রগতিবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর জাতীয় সম্মেলনে বোমা হামলার ভেতর দিয়ে। তারপর ২০০১ সালে সংগঠিত হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির পল্টনের জনসভার বোমা হত্যাকাণ্ড। তার কিছুদিনের মধ্যেই বোমা হামলা চালানো হয়েছিল রমনা বটমূলে ছায়ানটের নববর্ষের অনুষ্ঠানে। পরবর্তীতে একের পর এক ঘটেছিল দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা, আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে যেটি খেয়াল করার বিষয় তা হলো, সেসময় থেকে সাম্প্রদায়িক জঙ্গি অপশক্তি অনেকটা খোলামেলাভাবেই তার তৎপরতা ক্রমাগত বাড়িয়ে গেছে। অথচ, একটি সুসমন্বিত স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় কর্মকৌশল গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে, এই ভয়াবহ বিপজ্জনক শক্তিকে মোকাবেলা ও নিশ্চিহ্ন করার মতো উপযুক্ত পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। এই বিপদ মোকাবেলার কর্তব্যের প্রতি যথাযথ নজর দেয়ার বদলে দেশের তথাকথিত ‘মূলধারার’ দুটি রাজনৈতিক দল ও তাদের জোটের মনযোগ কেন্দ্রীভূত থেকেছে মূলত রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ে পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও ‘গদির জন্য নোংরা কামড়া-কামড়ির’ মধ্যে।

বেশ কিছুদিন ধরে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী শক্তি ব্যক্তিগত হত্যা-সন্ত্রাস চালিয়ে তাদের অভিসন্ধি কার্যকর করার নতুন পন্থা গ্রহণ করেছে। এখন টার্গেট করা মানুষদেরকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। ব্লগার, মুক্ত চিন্তার মানুষ, পুরোহিত-ভিক্ষু-যাজক, বিদেশি নাগরিকদের টার্গেট করে হত্যা করা শুরু হয়েছে। মন্দির-মঠ-গীর্জা- ইমামবারা ইত্যাদির ওপর বোমা হামলা করা হচ্ছে। এসবের দ্বারা একদিকে সাম্প্রদায়িক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে, অন্যদিকে ভয় ও আতংকের পরিবেশ সৃষ্টি করে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তোলপাড় তুলে আরো বড় রাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নেমে পড়েছে। তাদের এসব তৎপরতার সাথে সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে আইএস, আল-কায়দা ইত্যাদি আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদী নেটওয়ার্কের। আন্তর্জাতিক এসব জঙ্গি গোষ্ঠীর নেপথ্যের জন্মদাতা ও লালনকারী সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষত: মার্কিন-ইসরাইল চক্র। একথা আজ বিশ্বব্যাপী সুবিদিত। এভাবে, সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের অপতৎপরতাকে কেন্দ্র করে, সাম্রাজ্যবাদের ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের খেলার জালে বাংলাদেশকে আটকে ফেলার চেষ্টা আজ প্রায় সফল হতে চলেছে। চতুর্দিক থেকে আজ এক ঘোরতর বিপদ আমাদের দেশকে ঘিরে ধরেছে।

দেখা যাচ্ছে যে, দেশের ওপর সশস্ত্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের বিপদটি আসছে দু’দিক থেকে। একদিকে ধর্মান্ধ উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি ও অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদ। দু’দিক থেকে আসা এই প্রচণ্ড হামলার মুখে দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও জনজীবনের ন্যূনতম স্বস্তি-নিরাপত্তা চুরমার হতে বসেছে কেবল তাই নয়, দেশের স্বার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্বও আজ হুমকির মুখে এসে পড়েছে। দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো বজায় থাকলে এই বিপদ ও হুমকি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যে সম্ভব হবে না, বরঞ্চ তা যে বর্ধিত মাত্রায় ও নব-নব রূপে ক্রমাগত আবির্ভূত হতে থাকবে, সে কথা গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত। কারণ, এ প্রামাণ্য তথ্যটি কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, এসময়কালে এই একই আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মধ্যে দেশ পরিচালিত হওয়ার ফলে সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিপদ কেবল ক্রমাগত বৃদ্ধিই পেয়েছে। অনেক তথ্য আড়াল করে রেখে, অনেক বিষয়ের ওপর আপোসের প্রলেপ চাপিয়ে, একটু-একটু করে ক্রমাগত আত্মসমর্পণ করে একধরনের ভাব দেখানোর চেষ্টা হয়েছে যে সবকিছু ‘স্বাভাবিক’ রয়েছে এবং ‘কন্ট্রোলে’ আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষেএখন প্রায় সবকিছুর ওপর ‘কন্ট্রোল’ এদেশ ও দেশবাসীর কাছ থেকে কার্যত বহুলাংশে হাতছাড়া হয়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়ে গেছে।

ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের বিপদ সম্পর্কে বর্তমান ও বিগত সরকারগুলোর উদাসিনতা ও দায়িত্বহীনতা ক্ষমার অযোগ্য। বিএনপি গুলশান ও শোলাকিয়ার সশস্ত্র আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডের সাম্প্রতিক ঘটনার নিন্দা করেছে। কিন্তু একথা কি সে অস্বীকার করতে পারবে যে তাদের শাসনামলেই জামায়াত পুনর্বাসিত হয়েছিল, গোলাম আজমের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রীসভায় স্থান করে দেয়া হয়েছিল, জেএমবি ও বাংলা ভাইয়ের জন্ম দেয়া ও সৃজন করা হয়েছিল ইত্যাদি। বিএনপি এখনো জামায়াতকে তার জোট সঙ্গী করে রেখেছে। ইসলাম-পছন্দ দল হিসেবে নিজেকে জাহির করে সে নিজেকে তার একক চ্যাম্পিয়ান হিসেবে দাবি করে চলেছে। ইসলাম ও অন্ধ ভারত-বিরোধীতার কার্ড খেলে সে আওয়ামী লীগের ওপরে টেক্কা দেয়ার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে এধরনের আরো অনেক কথা উল্লেখ করার মতো আছে। আসলে সবকিছুই ‘হলো ক্ষমতার খেলার’ ভেল্কিবাজি!

একই সাথে এটিও দেখা যাচ্ছে যে, অনুরূপভাবে আওয়ামী লীগের কাছেও ক্ষমতার ইস্যুটিই মুখ্য হয়ে আছে এবং সে তুলনায় নীতি-আদর্শের প্রশ্নটি গৌণ বলে বিবেচিত আছে। ক্ষমতার সমীকরণ মিলানোর প্রয়াসে বিএনপি কর্তৃক একচেটিয়াভাবে ইসলামী কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগও এখন ভাগ বসানোর পথ নিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতাকে আদর্শগতভাবে ও রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার কাজে গুরুত্ব দেয়ার বদলে সে নিজেকে ‘বিএনপির চেয়ে কোনভাবেই কম ইসলাম-পছন্দ নই’ বলে প্রমাণ করতে মরিয়া চেষ্ট চালাচ্ছে। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করবো করবো বলে বহুদিন ধরে প্রতিশ্রুতি দিতে থাকলেও বছরের পর বছর ধরে সে এ কর্তব্যটি ঝুলিয়ে রেখেছে। জামায়াতের নেতাকর্মীদেরকে তার দলে স্বাগত জানানো হচ্ছে। সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ মূলনীতি ফিরিয়ে আনা সত্ত্বেও, জিয়াউর রহমানের ‘বিসমিল্লাহ’ ও এরশাদের ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের’ বিধান বহাল রাখা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও তার সরকারের কাজকর্মে এধরনের গুরুতর পদস্খলনের দৃষ্টান্তের অভাব নেই।

আরেকটি গুরুতর কথা হলো, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই অনেক বছর ধরে কার্যতঃ একধরনের ‘আদর্শবর্জিত বিরাজনীতিকরণের’ ধারায় তাদের দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। ক্ষমতাই এখন তাদের কাছে প্রধান ও একমাত্র লক্ষ্য, নীতি-আদর্শের বিষয়টি সেক্ষেত্রে প্রয়োজনমতো পরিত্যাজ্য। এভাবে, দেশের ‘মূলধারার’ রাজনীতিতে একটি ভয়ঙ্কর রকম মতাদর্শগত শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। সেই শূন্যতা পূরণের সুযোগ বামপন্থীদের ছিল। কিন্তু তারা নানা মতে ও দলে বিভক্ত। তাছাড়া, তারা অনেকে বিভ্রান্ত ও পথচ্যুত। ফলে বামপন্থীরা সেই শুন্যতা পুরণে এখনো অপরাগ হয়ে আছে। সৃষ্ট শুন্যতার ষোল আনা সুযোগ নিয়ে অনেকটা এগিয়ে যেতে স্বক্ষম হয়েছে সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদী শক্তিগুলো।

বিগত দশকগুলোতে দেশের অর্থনীতি ও সমাজ পরিচালিত হয়েছে ‘বাজার অর্থনীতির’ দর্শনের ভিত্তিতে। বাজার অর্থনীতি একদিকে জন্ম দিয়েছে ‘বাজার রাজনীতির’ ও অন্যদিকে ‘লুটপাটতন্ত্রের’। সমাজে বৈষম্য, কর্মহীনতা, বেকারত্ব ইত্যাদি বেড়েছে। জনগণ অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক পথে তাদের ভাত-কাপড়ের সমস্যা নিরসনের কোনো নিদর্শন ও সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে না। ফলে হতাশা ও ক্ষোভ তাদেরকে একধরনের জীবনবিমূখ উন্মাসিকতা ও আত্মকেন্দ্রীকতার গণ্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলছে। এর ফলে সাম্পদ্রায়িক জঙ্গিবাদের উদ্ভব ও প্রসারের এক উর্বর ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। দেশে যদি শক্তিশালী শ্রেণি সংগ্রাম ও জোরদার বামপন্থী আন্দোলন থাকতো তাহলে জনগণ অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক পথে তাদের ভবিষ্যৎ রচনার একটি পথ দেখতে পেত। কিন্তু সেক্ষেত্রে দুর্বলতা থাকার কারণে জনগণের মধ্যে অদৃষ্টবাদী চিন্তার প্রসার ঘটছে। এভাবেও সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের বিস্তারের পটভূমি ও সুযোগ প্রস্তুত হচ্ছে।

বিশ্ব পরিস্থিতিও সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের বিস্তারের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। সেটি তা করেছে দু’ভাবে। প্রথমত: সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর মার্কিন নেতৃত্বধীন তথাকথিত এককেন্দ্রীক বিশ্বে পশ্চিমা দুনিয়ার অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্য অপরাপর জাতি ও তাদের জীবন ধারার ওপর একচেটিয়াভাবে কর্তৃত্ববান হয়ে ওঠার বাস্তব আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনা পশ্চিমা দুনিয়ার বাইরে থাকা দেশের মানুষদের স্বকৃীয়তাকে অস্তিত্বহীন করে তোলার মতো বিপদের সম্মুখীন করে তুলেছে। স্বকীয় অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য তথাকথিত ‘বিশ্বায়নের’ দানবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের তাগিদ তাদের মধ্যে স্বাভাবিক কারণে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। শুধু নিজ-নিজ দেশের ভেতরেই নয়, বিশ্ব পরিমণ্ডলেও প্রতিরোধের শক্তি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা তাদের মাঝে সমান মাত্রায় জেগে উঠেছে। বিশ্বের কোন শক্তির ওপর ভরসা করে সেই বৈশ্বিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাবে? সোভিয়েত ইউনিয়ন তো নেই। তাই নতুন একটি বৈশ্বিক আন্দোলন প্রয়োজন। এরূপ পরিস্থিতিই ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদ ও তার আন্তর্জাতিক কাঠামো গড়ে তোলার পটভূমি রচনা করে রেখেছে।

দ্বিতীয়ত: মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বাধীন বিশ্বায়নকে, তার অস্তিত্বের স্বার্থেই, সমরাস্ত্র শিল্প ও সেসবের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর আরো বেশি করে নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। কিন্তু প্রতিপক্ষ রূপে কোনো একটি শক্তি যদি তার শত্রু হিসেবে না থাকে এবং যদি যুদ্ধ-বিগ্রহ-হানাহানি না থাকে, তাহলে অস্ত্রের ব্যবসা হবে কিভাবে? দেশে দেশে অস্থিতিশীলতার পরিবেশ উস্কে দিতে না পারলে অস্ত্রপাতি কেনার মতো দেশ কোথায় পাওয়া যাবে? একটি দেশকে সন্ত্রাসে আক্রান্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারলে, সেই সুযোগে সে দেশে হস্তক্ষেপ করে গোটা বিশ্বকে সে ‘কন্ট্রোলে’ রাখবেই বা কি করে? 

এসব কারণে সাম্রাজ্যবাদকে নিজের অস্তিত্বের স্বার্থেই, তার তেমন কোনো ভয়াবহ শত্রু না থাকলেও, সেরূপ শত্রু ‘পয়দা’ করতে হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল সাম্রাজ্যবাদের স্বাভাবিক প্রতিপক্ষ। তাই তাকে শত্রু রূপে চিহ্নিত করে একাজ চালানো হতো। এখন তাকে নিজের শত্রু নিজেকেই জন্ম দিতে হচ্ছে। এসব হিসেব থেকে সাম্রাজ্যবাদকেই ‘পয়দা’ করতে হয়েছে তালেবান, আল-কায়দা, আইএস ইত্যাদি ধর্মান্ধ সশস্ত্র ফ্যাসিস্ট জঙ্গি গোষ্ঠী। নিজেই এদের জন্ম দিয়ে ও লালন করে, এখন তাদেরকে দমন করার অজুহাতে সর্বত্র যুদ্ধ-হানাহানি-দেশ দখল ইত্যাদি সে চালিয়ে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের নীল-নকসা এর বাইরে মোটেও নয়। গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গিবাদী অ্যাকশানের পর তারা বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করার জন্য চাপ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে, প্রশ্ন রয়েছে যে গুলশান-শোলাকিয়ার কারণে হস্তক্ষেপের প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, নাকি হস্তক্ষেপের প্রয়োজনে গুলশান-শোলাকিয়া ঘটানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে!

সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ– এই উভয় দিক থেকে স্বদেশ আজ চরম হুমকির মুখে। একথা আগে থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। একমাস আগেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা বলেছেন “এসব হলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা”। “সব দেশেই এরকম ঘটনা ঘটে থাকে”। “ভয়ের কিছু নেই, পরিস্থিতি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে”। এসব মিথ্যা আশ্বাসে জনগণের মধ্যে সতর্কতার ও প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তাকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়েছিল। পরিস্থিতির বিপদ সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করার বদলে তাদেরকে “সব ঠিক আছে” বলে তাদেরকে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকতে বলা হয়েছিল। এটি শুধু জনগণের সাথে প্রতারণা করার মতো কাজই নয়, তা ছিল একটি অপরাধও বটে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কার কথায় এমনটি করলেন? এর দায় তাকেই নিতে হবে।

পরিস্থিতি দাবি করে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ১৬ কোটি মানুষের সম্মিলিত সতর্ক পাহারা ও সক্রিয় প্রতিরোধ। প্রতিরোধ গড়তে হবে জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক শক্তি ও তাদের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা সশস্ত্র জঙ্গি শক্তির বিরুদ্ধে। এরূপ বিভৎস ও ভয়ঙ্কর শক্তির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়া শুধু সরকারি দলের বা তার জোটের কর্মী-ক্যাডার-সমর্থক দিয়ে পক্ষে সম্ভব হবে না। তাছাড়া সরকারি দলে তো জামায়াতীরা দলে-দলে ঢুকে বসে আছে। সরকারি দল-বিরোধীদল সহ সব দল, সামাজিক শক্তি, ব্যক্তি– সকলকে একযোগে নামতে হবে। প্রশ্নটি ‘জাতীয় ঐক্যের’ নয়। ‘জাতীয় ঐক্য’ গড়ে উঠতে পারে নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক কর্মসূচির ভিত্তিতে। সে কর্মসূচিকে অবশ্যই হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারা তথা চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভিত্তিতে। কিন্তু এই মূহুর্তে যেটির জরুরি প্রয়োজন তা হলো সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তথা জামায়ত-আনসারুল্লাহ-জেএমবি ইত্যাদি গং-এর বিরুদ্ধে একযোগে মাঠে নামা।

তাহলেই ১৬ কোটি মানুষ সক্রিয় প্রতিরোধে পথে নামবে। যেভাবে তারা নেমেছিল একাত্তরে। কিন্তু বিএনপি যদি জামায়াতকে জোটসঙ্গী করে রাখে তাহলে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একযোগে মাঠে নামার জন্য তার আহ্বানের ন্যূনতম কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না। দেশের সামনে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদ ও বিদেশি হস্তক্ষেপের যে বিপদ তা থেকে আশু পরিত্রাণ পাওয়ার বিষয়টি তাই আপাতত: বহুলাংশে তাই নির্ভর করছে প্রথমত: বিএনপির জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করা ও দ্বিতীয়ত: ক্ষমতার ইস্যুর উর্দ্ধে উঠে সরকারের বিএনপি সহ সব দলকে একযোগে মাঠে নামানোর উদ্যোগ গ্রহণের ওপরে। অন্যথায় ভয়ঙ্কর বিপদ অনিবার্য হয়ে উঠবে।
আরো পড়ুন -->>

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ