কুড়িগ্রামে শিক্ষা সংকট / রিদওয়ান পর্ব


পশুত্বের স্তর থেকে মনুষ্যত্বের স্তরে উঠবার সিড়িই হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাই পারে মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত শিক্ষায় একজন মানুষকে সুশিক্ষিত করাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ। আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কী সেই কাজই করছে? কেনো পারছে না? কোথায় এর সংকট?

আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কুড়িগ্রাম জেলায়। আমার অভিজ্ঞতার আলোকেই তুলে ধরব কুড়িগ্রাম জেলার শিক্ষা সংকট এর কথা। পাঠক, আশা করি ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।

রাত গভীর হলে আমাদের এই প্রচলিত ভু-পৃষ্ঠ থেকে
ঘুমন্ত কুড়িগ্রাম ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যায়।
অগ্রাহ্য করে সকল মাধ্যাকর্ষণ।
তার ছোট ছোট রাজ্যপাট নিয়ে উড়ে উড়ে
চলে যায় দূর শুন্যলোকে।
–মাসুদ খান

প্রতিবছর দেবরাজ জিউস যেন দূর্যোগের রুপ ধরে গ্রাস করে কুড়িগ্রামকে ধ্বসিয়ে দেয় এর সমস্ত স্বপ্ন, বিচুর্ণ করে সমস্ত প্রতিজ্ঞা। বর্ষায় কুড়িগ্রামের ১৬ টি নদী এর জনপদকে ধংস করার জন্য টগবগ করে ফুলতে থাকে। এর স্বীকার হয় শিক্ষা ও শিক্ষার্থী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয় আশ্রয়কেন্দ্রে। কখনোবা পাঠশালা গ্রাস করে সুখের ঢেকুর তোলে নদ-নদীর রূপ হয়ে আসা দেবরাজ জিউস। বন্ধ হয় অসংখ্য স্বপ্ন দিয়ে গড়া পাঠশালাগুলো। সেই সাথে ছন্দপতন ঘটে শিক্ষার্থীদের অনাবিল হাসিমুখগুলোর।

দেবরাজ জিউসের আরেক নিষ্ঠুর রুপ দারিদ্রতা।কুড়িগ্রামে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭১ জনই দরিদ্র! ফলে পরিবারের অভাব মেটানোর দায়িত্ব পড়ে সদ্য কৈশোরে পা দেয়া, কৈশোর পেরোনো বা না পেরোনো শিক্ষার্থীর উপর।বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যালয়ে যাওয়া। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত হতে হয় অসময়েই ঝরে পড়া একেকটি সম্ভাবনাময় কচি কিশলয়কে। অন্যদিকে রয়েছে বাল্যবিবাহের বিষধর গ্রাস। জেলার দারিদ্র জনপদ মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয়াকে বলে "বেটিক ব্যাচে খাছি"।আদরের কন্যার পরিবার থেকে চলে যাওয়া যেন এক সস্তির নিঃশ্বাস। বাল্যবিয়ে এভাবেই নিভিয়ে দেয় অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে। এভাবেই অসংখ্য শিক্ষার্থীর নিষ্ঠুর পরিসমাপ্তি ঘটে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ ধাপের।

এবার আসি বিদ্যালয়গুলোর ভিতরের অবস্থায়।বেশিরভাগ বিদ্যালয়েই নেই পর্যাপ্ত সুবিধা। ক্লাসরুম গুলো জরাজীর্ণ। আধুনিক ব্যাবস্থা ও শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সরাঞ্জাম নেই বেশিরভাগ বিদ্যালয়েই।বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য থাকে না প্রয়োজনীয় সামগ্রীযুক্ত বিজ্ঞানাগার। অনেকের অভিযোগ প্রয়োজনীয় অনেক সামগ্রী নষ্টের পেছনে নাকি দায়ী খোদ শিক্ষার্থীরাই। একজন শিক্ষার্থী ৫ থেকে ৭ বছর অতিবাহিত করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তবু যদি তার মধ্যে মুল্যবোধের সৃষ্টি না হয় তবে সেই দায় কার?

প্রমথ চৌধুরী লাইব্রেরীকে বলেছেন মনে হাসপাতাল।অথচ জেলার প্রায় কোনো বিদ্যালয়েই নেই কার্যকরী কোনো লাইব্রেরী, বিদ্যালয়গুলোয় নেই পাঠ্যবইয়ের বৃত্তের বাইরের বই পড়ার অভ্যাস। জরাজীর্ণ ও পচে যাওয়া রুম গুলোকে ঘোষণা করা হয় লাইব্রেরী হিসেবে। এভাবেই বইচর্চা থেকে পিছিয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। আসক্ত হয় মাদকদ্রব্য সহ নানা ক্ষতিকর কাজে।

এবার তাকানো যাক কুড়িগ্রাম শহরের শিক্ষার দিকে।মফস্বল এ শহরে শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে চলে রমরমা শিক্ষাবাণিজ্য। প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থীই জড়িত বিদ্যালয়ের বাইরের অবৈধ কোনো না কোন শিক্ষাবাণিজ্যের সাথে। কিন্তু কেনো শিক্ষার্থীদের বাধ্য হতে হয় শিক্ষাবাণিজ্যের জালে আবদ্ধ হতে? এর দায় কী রাষ্ট্রের নেই? শহরের যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরীক্ষার সেন্টার সেগুলো বন্ধ থাকে প্রায় পাঁচ মাস। ফলে সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে পড়তে হয় কোনো না কোনো শিক্ষাবাণিজ্যের সাথে। গ্রামেও চলে রমরমা শিক্ষাবাণিজ্য। গ্রামের সাথে তাল মেলাতে খুব একটা পিছিয়ে নেই শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও।সেগুলোতেও নেই পর্যাপ্ত সুবিধা।

যেই জেলা দেশে দারিদ্রতম, সেই জেলাতেই করা হয় উন্নয়ন কনসার্ট। প্রতিবছর নিয়ম মেনে ও আধুনিক পদ্ধতিতে করা হয় উন্নয়ন মেলা। উন্নয়নের ভাঙা কাসোর গানেই যেনো শ্রান্ত হতে হবে ক্ষুধার্ত পাকস্থলীকে। দেবরাজ জিউসের এতসব অভিশপ্ত শক্তির হাত থেকে মুক্তির উপায় কী? তবে কী আশায় থাকতে হবে প্রমিথিউজের সেই অগ্নির। না, কোনো প্রমিথিউজ আসবে না শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের  বাচাতে। শিক্ষার্থীদেরই হয়ে উঠতে হবে একেকটি প্রমিথিউস৷ তবেই মিলবে কাঙ্খিত মুক্তি।

লেখকঃ সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কুড়িগ্রাম জেলা সংসদ
আরো পড়ুন -->>

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ