সুশান্ত বর্মণের প্রবন্ধ ‘তরুণদের বই না পড়া প্রসঙ্গে আমার পর্যবেক্ষণ’

তরুণরাই দেশের ভবিষ্যত। অথচ আমাদের দেশে তরুণরা জীবনবিকাশের পথে বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়, জীবনপথে এগিয়ে যাবার পথে সহ্য করতে হয় অপমানের আঘাত। আমাদের সমাজে একজন তরুণকে যতভাবে ছোট করা হয়, যতভাবে দোষী সাজানোর চেষ্টা করা হয় তা সভ্য সমাজের মাপকাঠিতে কোনভাবেই কল্পনা করা সম্ভব নয়। আমাদের সমাজে তরুণরা তবুও যে বেঁচে আছে, ভবিষ্যতের আলোকিত সমাজের স্বপ্ন দেখে তা শুধু তারুণ্যের উদ্দীপনার কারণে। বিপরীতে প্রবীণরা তরুণদের সহায়তা তো দূরের কথা, যতটা সম্ভব বঞ্চনা ও অপমানের ঘেরাটোপে বন্দী করে। তারুণ্য বিকাশে উৎসাহ তো দূরের কথা বরং নবীনদের দোষী সাব্যাস্ত করায় তাদের আগ্রহ সীমাহীন।

বর্তমান সময়ে তরুণ প্রজন্মের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। এই অভিযোগটি সম্পর্কে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে নতুন প্রজন্ম বই পড়ে না। বইয়ের সান্নিধ্য থেকে তারা দূরে সরে যাচ্ছে। এজন্য অনেকে নানাবিধ প্রসঙ্গকে সামনে নিয়ে এসে তরুণদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেন। কিন্তু আমি অভিযোগের আঙ্গুল তুলতে চাই প্রবীণদের দিকেই। প্রাকৃতিক নিয়মেই তরুণরা অনভিজ্ঞ। পৃথিবীর রূপ রস গন্ধের সন্ধান তাদের নিকট অজানা। এই অনাবিষ্কৃত জগতের দ্বার খোলার দায়িত্ব প্রবীণদের। তারা যদি নিজেরা বইবিমুখ থাকেন; তাহলে তার দায় তরুণদের নিতে হবে কেন?

আমার পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা সমকালীন মতামতের বিপরীত। আমি দেখেছি তরুণরা বই পড়তে আগ্রহী, তারা বইয়ের সান্নিধ্য পেতে চায়; একটি নতুন বইয়ের গন্ধ পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। কিন্তু এই সমাজের প্রবীণরা তাদের সামনে বইয়ের জগতকে উন্মোচন করেন না। তাদের সামনে বইয়ের পাতা মেলে ধরেন না। শিশু-কিশোর-তরুণদের পছন্দের বিষয়ের বইয়ের খোঁজ রাখেন না। নবীন প্রাণের সামনে যথোপযুক্ত বইকে উপস্থাপন করেন না। প্রবীণদের এরকম অবহেলার কারণে একজন উৎসাহী তরুণ তার পছন্দের বিষয়ের বইয়ের খোঁজ পায় না।
 
প্রবীণরা নিজেরাই যেখানে বই পড়েন না; নিজেকে সর্ববিষয়ে অভিজ্ঞ ভাবার অহংকার করেন, বই না পড়ার গ্লানিকে উপেক্ষা করেন, সেখানে একজন নবীন-প্রাণ কী শিখবে? কার কাছে জানবে বইয়ের রোমাঞ্চকর জগতের খবর? বই বিমুখ প্রবীণের সন্তান বইপ্রেমী হবে, তা আমরা আশা করি কীভাবে? নিজেদের অজ্ঞতার দায়, ব্যর্থতার দোষ তরুণদের উপর চাপিয়ে দিয়ে তৃপ্ত থাকলে হবে? যে শিশু কখনো তার পিতামাতা আত্মীয়স্বজন মুরুব্বী প্রতিবেশীকে বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়তে দেখেনি, সে কীভাবে বইকে ভালবাসতে শিখবে। তার পরিবার তো তার হৃদয়ে বইয়ের প্রতি ভালবাসাবোধ তৈরি করতে পারেনি; বইয়ের পাতায় পাতায় লুকিয়ে থাকা আনন্দপথের রেখা দেখাতে পারে নি।

বাংলাদেশের সমাজের পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার নেই; নেই বই বিষয়ক আলোচনার আয়োজন। প্রবীণরা ব্যস্ত নানাবিধ আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা নিয়ে। এমন বিরূপ পরিবেশে অভিজ্ঞতাহীন এক নবীন নিজে নিজে বইপ্রেমিক হয়ে উঠবে এ প্রত্যাশা বালখিল্যতামাত্র। আর এর দায় তরুণদের উপর চাপিয়ে দেয়ার অর্থ নিজের ব্যর্থতা, সীমাবদ্ধতা লুকিয়ে রাখার অপচেষ্টামাত্র। অর্থাৎ আমি মনে করি, বই না পড়ার গ্লানি তরুণদের নয়, প্রবীণদেরই। এই প্রসঙ্গে প্রাচীন প্রবাদটিও আমার ধারণাকে সত্যায়িত করে। যেখানে বলা আছে—
Like father like son


আরো পড়ুন -->>

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. স্যার, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। এ দেশের তরুণদের জীবন অভিশপ্ত।

    উত্তরমুছুন
  2. আপনার পর্যবেক্ষণ সঠিক ও গ্রহণযোগ্য। মুরুব্বীরা শুধু দোষ ধরতে জানে, কোন প্রশংসা করতে পারে না।

    উত্তরমুছুন
  3. অনামা আশা২০/৯/২০, ১১:১০ PM

    আপনার মতো করে তরুণ সমাজকে কেউ বুঝতে চায় না। আপনার কথা খুব সত্যি। আমরা বই পড়তে চাই, কিন্তু আমাদের পছন্দ কেউ জানতে চায় না।

    উত্তরমুছুন

অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্যের দায় মন্তব্যকারীর, সম্পাদকের নয়।