আরব আলী যাত্রাপুরী একজন বিখ্যাত বক্তা। স্বপ্ন জাগরণে ভাষণই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। একদিন ভাষণ দিতে না পারলে মনে হয় জাতির অশেষ ক্ষতি সাধিত হলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাষণ প্রাকটিশ শুরু। পহেলা চড়াও হন সহধর্মীনি মর্জিনা বেগমের ওপর। নাস্তা তৈরীতে বিলম্ব নিয়ে ঝাড়া ৩০ মিনিট জ¦ালাময়ী ভাষণ দেন। আলসেমীর জন্য এই জাতি সর্বক্ষেত্রে কীভাবে পিছিয়ে পড়ছে- সে বিষয়ে নাতিদীর্ঘ অথচ জ্ঞানগর্ভ বাণী বর্ষণ করেন তিনি। তারপর তাঁর অন্ন ধবংসের অভিযোগে গুণধর পুত্র কন্যাদের চৌদ্ধ গোষ্ঠী উদ্ধার করে তাঁর ভাষণ প্রাকটিশের যবনিকা টানেন।
চায়ের সাথে পত্রিকার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে তিনি দিনের সিডিউলটা চেক করেন। আজ কয়টা সভায় বক্তব্য দিতে হবে নোট নেন। চারদিক থেকে যেভাবে ভাষণ দেয়ার আমন্ত্রণ আসছে, তাতে শীঘ্রই পেশাদার বক্তা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দিতে পারবেন। তবে যে হারে ভাষণের ডাক আসছে তাতে ভাষণপ্রতি একটা হাদিয়া ধার্য করার কথাও ভাবছেন আরব আলী। অবশ্য এনজিওদের সভায় গেলে মাঝে মধ্যে হলুদ, খয়েরী বা সাদা খাম ধরিয়ে দেয়া হয়। এ হচ্ছে ভাষণের কদর।
আরব আলী যাত্রাপুরী ভাবেন, ক্যারিয়ারের শুরুটা এমন সহজ ছিলোনা। স্টেজে উঠলে ঢোক গেলা, হা-পা কাঁপাসহ নানান বিকার-বাতিক চাগান দিতো। রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীতে মরহুম দুই গুণি মানুষকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঝটপট বক্তব্য শেষ করায় সভাস্থলে হাস্যরস উথলে উঠেছিলো। অথবা আমার পূর্ববর্তী বক্তার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত, যা বলতে চাই তা হয়তো পরবর্তি বক্তা বলবেন-এই অজুহাতে ভাষণ শেষ করে দ্রুত দর্শক সারিতে গায়েব হয়ে যেতেন।
এখন অবশ্য সেদিন নেই। এখন আমন্ত্রণ এলে তিনি খোঁজ নেন তাকে বক্তব্য দিতে দেয়া হবে কীনা। বক্তব্যের সুযোগ না থাকলে তিনি ব্যস্ততার অজুহাতে আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করেন। আর বক্তব্য দেয়ার সুযোগ থাকলেতো কথাই নেই। নির্ধারিত সময়ের আধাঘন্টা পুর্বে সভাস্থলে হাজির হন। এরপর অপেক্ষা করেন কখন তার নাম ধরে ডাকবেন উপস্থাপক। বিলম্ব হলে উশ্খুশ্ করেন। তাগাদা দেন আয়োজকদের।
এরপর এলো মাহেন্দ্রক্ষণ। ডাক পড়লো মঞ্চে। লেপ্টে গেলেন ডায়াসের সাথে। কতো কথা যে আছে! ফুরাইতে চায়না। বারবার স্লিপ দিয়ে সংক্ষেপ করার অনুরোধ করা হয়। তিনি অবশ্য সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেন না।
এক সময় দর্শক সারিতে ভিড় পাতলা হতে থাকে। তিনি যখন তার জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য শেষ করেন, তখন অনুষ্ঠানের দফারফা। আরো কয়েকটি সভায় ভাষণ দিতে হবে-কাজেই আলবিদা বলে কেটে পড়েন তিনি। এই বয়সে তিনি শ্রোতা হতে চান না। শুধু বলতে চান।
সমস্যা হচ্ছে সভাগুলোতে বক্তার সংখ্যা বাড়ছে। এখন কোন সভায় গেলে দেখা যায় শ্রোতার চেয়ে বক্তার সংখ্যাই বেশী। তার উপর সভাপতি মহোদয় তার সমাপণী বক্তৃতা ছাড়াও প্রটোকল ভেঙে শুরুর দিকে কায়দা করে একদফা চাঞ্জ নেন। ফলে আরব আলীর ভাষণ তৃষ্ণা অপূর্ণই থাকছে। দু’দিন বক্তৃতা দিতে না পারলে হাঁসফাঁস করেন। বাড়তি বিপর্যয় হিসেবে গলার রগ ফুল ওঠে। ডাক্তার মমিনুল ইসলামের মতে- এ হচ্ছে ‘স্পিচ সিনড্রোম’। মহাঝামেলা। ভাষণ দিতে না পেরে ব্যামার।
অবশ্য এই অবস্থা থেকে পানাহ্ পেতে আজকাল মাঝে মধ্যে আয়োজকদের উস্কে দেন। এতে দুই চারশ টাকা খরচাও করেন আরব আলী যাত্রাপুরী। তাতেও আপদ কাটছেনা। পাড়ার লোকরা তাকে দেখলেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠে দ্রুত গায়েব হন। ভাষণভীতি এদেরকে যমের মতো তাড়া করে। আয়োজকরাও সভা পন্ড হবার ভয়ে তাকে আমন্ত্রণ জানাতে দ্বিধাগ্রস্থ। তার উপর বিষয় বহির্ভূতভাবে বক্তব্য নিয়ে আয়োজকদের প্রায়ই ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন। ফলে আরব আলীর ভাষণ চর্চার একটা মন্দা সময় যাচ্ছে বলা যায়।
আরো পড়ুন -->>
2 মন্তব্যসমূহ
ভাল লাগল। সুন্দর লেখা। লেখকের হাতের লেখার যশ হোক এই দোয়া করি।
উত্তরমুছুনভারী সুন্দর, লেখক তার মনের কথাই বলেছেন দেখে ভাল লাগল
উত্তরমুছুনঅনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্যের দায় মন্তব্যকারীর, সম্পাদকের নয়।